বৈষম্যহীন নতুন বাংলাদেশ চাই

প্রকাশিত: ৮:৫৭ অপরাহ্ণ, অক্টোবর ২, ২০২৪

বৈষম্যহীন নতুন বাংলাদেশ চাই

মামুনুর রশিদ : আমাদের সংবিধানের ২৮ অনুচ্ছেদে উল্লেখ করা হয়েছে কেবল ধর্ম, বর্ণ, গোষ্ঠী, নারীপুরুষভেদ বা জন্মস্থানের কারণে কোনো নাগরিকের প্রতি বৈষম্য করা যাবে না।রাষ্ট্র ও গণজীবনের সর্বস্তরে নারীপুরুষের সমান অধিকার থাকবে । কেবল ধর্ম, বর্ণ, গোষ্ঠী, নারী পুরুষভেদ বা জন্মস্থানের কারণে জনসাধারণের কোনো বিনোদন বা বিশ্রামের স্থানে প্রবেশের কিংবা কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তির বিষয়ে কোনো নাগরিককে কোনোরূপ অক্ষমতা, বাধ্যবাধকতা, বাধা বা শর্তের অধীন করা যাইবে না। সংবিধানে নিশ্চয়তা থাকা সত্বেও নাগরিকরা বৈষম্যের স্বীকার হচ্ছে।

আমাদের প্রথমেই জানা দরকার বৈষম্য কি? বৈষম্য এর সমার্থক শব্দ হলো পার্থক্য, প্রভেদ, অসমতা। বৈষম্যমূলক শব্দের অর্থ হলো পক্ষপাতমূলক আচরণ দ্বারা চিহ্নিত বা দেখানো, বিশেষত জাতিগত, ধর্মীয় বা যৌন পক্ষপাতের ইঙ্গিত হিসেবে । বৈষম্য হলো নির্দিষ্ট সাধারণ বৈশিষ্ট্যের কারণে ব্যক্তি বা সামাজিক গোষ্ঠীর উদ্দেশ্য বা সম্পন্ন পার্থক্যমূলক আচরণ। আইনের দৃষ্টিতে সমাজে প্রধানত চার ধরনের বৈষম্য রয়েছে: প্রত্যক্ষ, পরোক্ষ, হয়রানি এবং সাংগঠনিক বৈষম্য ।

 

প্রত্যক্ষ বৈষম্য ঘটে যখন একইরকম পরিস্থিতিতে একজন ব্যক্তির সাথে অন্য ব্যক্তির তুলনায় বর্ণ, জাতি, জাতীয় বা জাতিগত উৎস, বংশ, জন্মের ভিত্তিতে , ধর্মীয় বা অন্যান্য প্রত্যয়, অক্ষমতা বা দীর্ঘস্থায়ী অসুস্থতা, বয়স, বৈবাহিক বা সামাজিক অবস্থান, যৌন অভিমুখীতা, লিঙ্গ পরিচয় বা লিঙ্গ বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে কম অনুকূল আচরণ করা হয়, করা হয়েছে বা করা হবে।

 

পরোক্ষ বৈষম্য ঘটে যখন একটি আপাত নিরপেক্ষ অবস্থান, মানদণ্ড বা চর্চা পূর্বোক্ত বৈশিষ্ট্যের অধিকারী ব্যক্তিদের অন্যান্য ব্যক্তির তুলনায় অসুবিধায় ফেলতে পারে।নিপীড়নকে বৈষম্যের একটি রূপ বলে গণ্য করা হয় যেখানে অবাঞ্ছিত আচরণ ঘটে যা উপরোল্লিখিত ভিত্তিগুলোর একটির সাথে যুক্ত, যা একজন ব্যক্তির মর্যাদাহানীর উদ্দেশ্যে করা হয় বা একজন ব্যক্তির মর্যাদা লঙ্ঘন করা হয়, এবং যেখানে একটি ভীতিকর, প্রতিকূল, অবমাননাকর, অপমানজনক বা আক্রমণাত্মক পরিবেশ তৈরি করা হয়।সাংগঠনিক বৈষম্য হলো উপরোল্লিখিত নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন এক বা একাধিক ব্যক্তির সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কারণে একজন ব্যক্তির সাথে কম অনুকূল আচরণ করা।

 

এছাড়াও আরও কিছু বৈষম্য সমাজে দেখা যায় যেমন, অনুভূত বৈশিষ্ট্যের উপর ভিত্তিকরে বৈষম্য করা মানে হলো এমন একজন ব্যক্তির প্রতিকম অনুকূল আচরণ করা যার উপরোক্ত নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য রয়েছে বলে ধারণা করেনেওয়াহয় । একাধিক বৈষম্য হলো উপরোক্ত একাধিক ভিত্তির উপর নির্ভর করে একজন ব্যক্তির বিরুদ্ধে কোনোবৈষম্য, বর্জন বা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা। এছাড়াও, “যুক্তিযুক্ত বাসস্থান অস্বীকার“কে অক্ষমতা বা দীর্ঘস্থায়ী অবস্থার ব্যক্তি দের জন্যবৈষম্য বলে গণ্য করা হয় ৷ বৈষম্য কোনোওব্যক্তি, ব্যবসা, সংস্থা, পাশা পাশি রাষ্ট্রদ্বারাওপরিচালিত হতে পারে।

 

 

জাতীয় আয়ের প্রবৃদ্ধি, মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি, বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের প্রবৃদ্ধি, নারীর ক্ষমতায়ন, সর্বোপরি গড় আয়ু বৃদ্ধি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের বার্তাই প্রকাশ করে থাকে। দেশের এ অর্থনৈতিক উন্নয়নের মাঝেও যে তথ্যটিএকটিনেতিবাচকঅবস্থারজানান দেয় তাহলো অর্থনৈতিক বৈষম্য। ধনীদরিদ্রের আয় ও সম্পদ বৈষম্য, জেন্ডার বৈষম্য, দরিদ্রের আয় ও সম্পদ বৈষম্য পৃথিবীব্যাপী আজ এক আলোচিত বিষয়। ধনীদরিদ্রের বৈষম্য পরিমাপক আন্তর্জাতিক পদ্ধতি জিনি সহগের মান অনুসারে বর্তমানে আমাদের দেশের বৈষম্য স্তর রেড জোনের খুব কাছাকাছি। দেশে দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে বহুতল বিশিষ্ট সুউচ্চ অট্রালিকা, রাস্তায় নামিদামি বিভিন্ন মডেলের গাড়ি, তেমনি পাল্লা দিয়ে বেড়ে যাচ্ছে ট্রাফিক সিগন্যালে দাঁড়ানো গাড়ির দিকে বাড়ানো ভিক্ষুকের হাত আর ফুটপাতে ঘুমানো মানুষের সংখ্যা। অর্থনৈতিক এ বৈষম্যের সঙ্গে সঙ্গে বেড়ে চলেছে সামাজিক অপকর্ম এবং অসামঞ্জস্যতা। দরি্রি মানুষ শুধু অরথনৈতিকভাবে বঞ্চিতই হচ্ছে না, শিকার হচ্ছে বিভিন্ন সামাজিক প্রতিকূল অবস্থার।

 

 

দেশের এ বৈষম্য দুর করতে সরকার বিভিন্ন সামাজিক নিরাপত্তাপূলক অর্থনৈতিক কার্যচক্রম চালু করলেও ধনাঢ্যদের আয় এবং সম্পদ যে হারে বেড়ে চলেচে তার সঙ্গে তাল মেলানো সম্ভব হচ্ছে না। অর্থনৈতিক এ বৈষম্য সহনীয় পর্যাকয়ে আনা সম্ভব হবে না, যতদিন না দুর্নীতি, ঋণখেলাপি, কর ফাঁকির প্রবণতা রোধ রা সম্ভব হবে। সেই সঙ্গে দেশের এ অর্থনৈতিক উন্নয়নের সূচক যতই উর্ধ্ব মূখী হোক না কেন ধনী দরিদ্রের বৈষম্য যতদিন প্রহণযোগ্য পর্যাময়ে নিয়ে আসা সম্ভাব না হবে ততদিন এ উন্নয়ন টেকসই হবে না। আয়বৈষম্য বৃদ্ধির জন্য বেশ কিছু কারণকে দায়ী করা যেতে পারে। এক. জমি ও সম্পদের অসম বণ্টন, যা উৎপাদনশীল সম্পদ ও সুযোগে দরিদ্রদের অধিকার সীমিত করে। দুই. প্রগতিশীল কর এবং প্রয়োজনীয় সামাজিক সুরক্ষা নীতির অভাব, যা ধনী থেকে দরিদ্রদের মধ্যে আয় ও সম্পদ পুনর্বণ্টন করতে ব্যর্থ হয়। তিন.কিছু অভিজাত শ্রেণির হাতে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করা, যারা তাদের প্রভাব ব্যবহার করে অতি মুনাফা, ভর্তুকি, চুক্তি ও তাদের স্বার্থের অনুকুল নীতিগুলো দখল করে।

 

চার. শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পানি, স্যানিটেশন ও অবকাঠামোর মতো সরকারি পরিষেবার প্রয়োজনের তুলনায় অভাব ও নিম্নমান, যা সামগ্রিক মানব উন্নয়ন ও দরিদ্রদের উন্নয়নকে ব্যাহত করে। পাঁচ. নারী, জাতিগত সংখ্যালঘু, ধর্মীয় সংখ্যালঘু ও গ্রামীণ অধিবাসীর মতো প্রান্তিক গোষ্ঠীর ক্ষেত্রে বৈষম্য, যারা অধিকার, ন্যায়বিচার ও সুযোগের ক্ষেত্রে বিভিন্ন বাধার সম্মুখীন হয়।বাংলাদেশে ক্রমবর্ধমান আয়বৈষম্য সামাজিক–অর্থনৈতিক উন্নয়নে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলছে। এটি সামাজিক সংহতি ও বিশ্বাসকে ক্ষুণ্ন করে, অসন্তোষ ও সহিংসতাকে উসকে দেয়, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান ও জবাবদিহিকে ক্ষয় করে, দারিদ্র্য হ্রাস ও মানব উন্নয়নে বাধা দেয়, অর্থনৈতিক দক্ষতা ও উৎপাদনশীলতা হ্রাস করে এবং পরিবেশগত ভারসাম্যকে হুমকির মুখে ফেলে।

 

যারা শিক্ষাদীক্ষায় সার্টিফিকেটদারি যোগ্যতা অর্জন করতে পেরেছে, তাদের কর্মসংস্থান, আয়ের মধ্যে জীবন-জীবিকায় অভাব থাকে না। পরিবার ও সমাজে তারা স্বাচ্ছন্দ্য ও স্বচ্ছল জীবনযাপন করছে। পক্ষান্তরে কম শিক্ষিত এবং অশিক্ষিত দিনমজুর, মধ্যবিত্ত, নিম্নআয়ের মানুষের ইনকাম করে সমাজের চাহিদা পূরণ করে বেঁচে থাকা একটি কঠিন পরীক্ষা। নিম্ন মধ্যবিত্ত দিনমজুর অসহায় ও নির্দিষ্ট স্বল্প আয়ের মানুষগুলো সমাজে চরমভাবে বিপর্যস্ত।দুর্বল মানুষগুলো নিঃস্ব থেকে সর্বহারা হচ্ছে। তারা খেয়ে-দেয়ে বেঁচে থাকতে কঠোর পরিশ্রম করেও সফল হতে পারছে না।

 

 

সামাজিক বৈষম্যমুক্ত পৃথিবী গড়তে নৈতিক ও আদর্শিক পরিবর্তন ঘটানোর মাধ্যমেই নিশ্চিত করতে হবে।প্রতিটি মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার, বাকস্বাধীনতা, ঐচ্ছিক স্বাধীনতা, সামাজিক স্বাধীনতা, মানসিক স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে। দলমত নির্বিশেষে সকল মানুষ কে“মানুষ”–হিসেবে মর্যাদা দিতে হবে।জুলাই বিপ্লব আমাদের সামনে এক নতুন দিগন্ত উম্মোচন করে দিয়েছে।এ সুযোগ কাজে লাগাতে হবে।তাদের স্বপ্নের নতুন বাংলাদেশ গড়তে হবে।‘সকল তরুণ যোদ্ধা, যাঁরা জীবন দিয়েছেন, তাঁরা শহিদের মর্যাদা এবং যাঁরা বেঁচে আছেন, তাঁরা তাঁদের আত্মত্যাগের সঠিক মূল্যায়ন করতে হবে।’

 

 

সংশ্লিষ্ট সকলকে কাজের মাধ্যমে জনগণের বিশ্বাস, ভালোবাসা অর্জন করে জনগণের সঙ্গে থাকতে হবে। বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গঠনের এ যাত্রার জন্য আরও কিছু সময় ও পথ আমাদের এক সাথে পাড়ি দিতে হবে। এজন্য সন্ত্রাস নয়, বরং ধৈর্য ধরতে হবে।

পিআইডি ফিচার