প্রকাশিত: ৯:৪৯ অপরাহ্ণ, জুলাই ১০, ২০২৪
জে মোর্শেদ আলম : তথ্যপ্রযুক্তি এখন মানুষের হাতের মুঠোয়। আর এর কল্যাণে দেশের সকল সেক্টরই অসম্ভব দ্রুতগতিতে ডিজিটাল হয়ে উঠছে। ব্যবসাবাণিজ্য থেকে শুরু করে আর্থিক লেনদেন সব জায়গায় এখন তথ্যপ্রযুক্তির জয়জয়কার।আর এর কল্যাণে মানুষের জীবনে এসেছে সাচ্ছন্দ্য ।খুব সহজেই ঘরে বসে কয়েক মিনিটের মধ্যেই আর্থিক লেনদেনের কাজটি সম্পন্ন করা সম্ভব হচ্ছে। ডিজিটাল প্রযুক্তির সাহায্য নিয়ে ঘরে বসেই করা যাচ্ছে ব্যবসাবাণিজ্য। ডিজিটাল প্রযুক্তি মানুষের জীবনকে যেমন সহজ ও সাচ্ছন্দ্যপূর্ণ করেছে তেমনি দূর্বিস করেও তুলেছে।অসচেতন ও লোভী মানুষ প্রতিদিন ডিজিটাল প্রতারণার স্বীকার হচ্ছে,ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে আর্থকভাবে।কোনোভাবেই থামানো যাচ্ছে না ডিজিটাল প্রতারণা।
কার হাতে নেই মোবাইল ফোন, কম্পিউটার ও ইন্টারনেট,হোক সে ধনী বা গরিব। মোবাইল ফিনেনসিয়াল সার্ভিসকে ঘিরে সক্রিয় অসংখ্য ডিজিটাল প্রতারক চক্র। ফোন করেই মানসিক চাপে ফেলে তথ্য হাতিয়ে নেওয়ার কৌশলের কাছে হার মানেন অনেকেই। কিছু কিছু চক্র ভুয়া অনলাইন পেজ খুলে গ্রাহকদের সঙ্গে প্রতারণা করছে এবং লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে।
ইদানিং বাংলাদেশে একাধিক কোম্পানি বেরিয়েছে যারা মালটিলেভেল মার্কেটিংয়ের মাধ্যমে আউটসোর্সিংকে পণ্য হিসেবে ব্যবহার করছে। তাছাড়া অনলাইনের মাধ্যমে সাশ্রয়ী দামে গ্রাহক পর্যায়ে সরাসরি পণ্য পৌঁছে দিতে দেশে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে ই-কমার্স ব্যবসা। অনলাইনে ক্রেতাদের কাছ থেকে পণ্য সরবরাহে প্রি-অর্ডারের নামে অগ্রিম টাকা নিয়েও করছে প্রতারণা। এমন হাজার হাজার ঘটনার দু-একটি এখানে উল্লেখ করছি:
অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা শাহাজান সাহেব সরকারি কর্মচারী কল্যাণ বোর্ডে চিকিৎসা সহায়তার জন্য আবেদন করেছিলেন। সেই তথ্য জেনে যায় প্রতারকেরা। প্রতারকেরা তাঁকে সহায়তা দেওয়ার কথা বলে কৌশলে ক্রেডিট কার্ডের পিন নম্বর নিয়ে নেয়। এরপর ১০ দফায় ওটিপি (ওয়ান টাইম পাসওয়ার্ড) নম্বর নিয়ে ১০টি লেনদেনের মাধ্যমে প্রায় দুই লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়।
এরকমই আরও একটি ঘটনায় য়ুবায়ের লেলিন খুয়েছেন দশ লাখ টাকারও বেশি । ‘অ্যাডভান্স টাস্কস ৪৪৪’ নামের একটি টেলিগ্রাম গ্রুপে প্রতারকরা আর্থিক প্রলোভন দেখিয়ে যুক্ত করে তাকে। সেখানে বিভিন্ন টাস্ক শেষ করে তিনি আট হাজার টাকা পর্যন্ত আয় করেন। তারপর তাকে বলা হয়, ‘সি-ফাইন্যান্স’ নামে একটি সাইটে রেজিস্ট্রেশন করতে হবে এবং নয় হাজার টাকা রেজিস্ট্রেশন ফি দিতে বলা হয়। এর কয়েকদিন পর আবারও তাকে ৩৬ হাজার টাকা দিতে বলা হয়। এভাবে অতিরিক্ত সুদসহ ফেরত দেওয়া হবে এমন প্রতিশ্রুতি দিয়ে তার কাছ থেকে দশ লাখ হাতিয়ে নেয় প্রতারকরা।
বিশ্বজুড়ে সাধারণ সাইবার অপরাধের একটি ধরন হলো ‘পরিচয় চুরি’ বা আইডেনটিটি থেফট। ব্যক্তিগত তথ্য নিয়ে প্রতারকেরা ব্যাংক হিসাব, ক্রেডিট কার্ড অথবা মুঠোফোনে আর্থিক সেবা (এমএফএস) হিসাব থেকে টাকা হাতিয়ে নেয়, এমনকি ব্যাংকঋণও নিয়ে থাকে । উৎসব-পার্বণে মানুষের কেনাকাটা বেড়ে যায় কয়েক গুণ। প্রযুক্তির প্রসারে শহরের মানুষ ডিজিটাল লেনদেনেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোও নিজেদের গ্রাহকের জন্য নানা অফার দিয়ে থাকে। এ সময় ওত পেতে থাকা প্রতারকেরাও মানুষকে ফাঁদে ফেলার চেষ্টা করে। এজন্য ডিজিটাল লেনদেনে নিরাপদ থাকার বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের প্রথম কথাই হচ্ছে, লোভকে সংবরণ করুন,সচেতন হোন নিরাপদ থাকুন।
সাইবার অপরাধীরা সাধারনত যে সব কৌশলের মাধ্যমে অপরাধ করে থাকে তা নিম্নে উল্লেখ করা হলো :
পঞ্জি (PONZI): ১৯২০ সালে চার্লস পঞ্জি নামে একজন ইতালীয় ইমিগ্যান্ট হঠাৎ করে মানুষের টাকা ৯০ দিনে গ্যারান্টি সহকারে ডাবল করে দেয়ার ঘোষণা দিলেন, তার নামানুসারে এই প্রতারাণার কৌশলকে পঞ্জি স্কীম নামে ডাকা হয়। এ ধরনের প্রতারকরা স্বল্প সময়ে ডবল বা তারচেয়েও বেশি মুনাফা দেওয়ার কথা বলে বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ঠ করে। প্রথমদিকের কিছু বিনিয়োগকারী আর্থিকভাবে লাভবান হলেও অধিকাংশ মানুষ প্রতারিত হয়। পঞ্জি স্ক্যামের একটা বৈশিষ্ট হলো এখানে একই কমিউনিটর মানুষ বেশি প্রতারিত হয়।
পঞ্জি স্ক্যামের একটি সাধারন কৌশল হলো চাকুরি দেবার নামে অনেক মানুষের কাছ থেকে অগ্রিম অনেক টাকা নেয়া অথবা বিদেশে চাকরির অফার লেটার আসেছে মেডিকেল করতে কিছু টাকা দ্রুত দিতে হবে ইত্যাদি। পঞ্জি স্কীমে কোনোদিন সকল গ্রাহকে একসাথে টাকা দিতে পারবে না। বাংলাদেশে ইভ্যালির ১০০ বা ১৫০% ক্যাশব্যাক পরিস্কার পঞ্জি স্কীম যেখানে কিছু লোক অত্যন্ত কম দামে পন্যটা পাবে কিন্তু বেশিরভাগ নতুন ক্রেতা অপেক্ষা করবে। ইভ্যালি পঞ্জি স্কীমটাকে টাকার বদলে পন্যে রূপান্তর করেছে ।
পিরামিড স্কীম:বাংলাদেশে এমএলএম বিজনেস মূলত পিরামিড স্কীম। ডেসটিনির মত অনেক প্রতিষ্ঠান এ দেশে সব থেকে বড়ো স্ক্যামটি করেছে পিরামিড স্ক্যাম ব্যবহার করে। এমএলএম এর প্রধান কাজ মূলত নতুন মানুষকে দলে সদস্য করা, এবং সেই সদস্যের টাকা যিনি দলে ভেড়ায় তাকে আর কোম্পানির মধ্যে ভাগ করে দেওয়া হয়। পিরামীড স্কীমের অনলাইন বা অফলাইন যে কোনো ভার্সনেই চলতে পারে। পিরামিড স্কীম মূলত একটা সময়ে খুব বুষ্ট করে যখন বেশ কিছু সংখ্যক সদস্য হয় তখন প্রথম দিকের সদস্যরা ফুলে ফেপে ওঠে, প্রথম দিকের টাউট বাটপাররা দ্রুত গাড়ি বাড়ির মালিক হয়ে যায় যা দেখে বাকিরা স্বপ্ন দেখে এবং প্রতারিত হয়।
পাম্প এন্ড ডাম্প ( Pump & Dump): এই কৌশলটা অনেক বেশি টেকনিক্যাল এবং প্রফেশনাল। পাম্প এন্ড ডাম্প স্ক্যামে প্রথমে যে কোনো জিনিসের মূল্য প্রতারণার উদ্দেশ্যে অস্বাভাবিক বাড়ানো হয় , যা দেখে অন্যরা মনে করে এটা এখন কিনে রাখলে অধিক লাভবান হওয়া যাবে। এভাবে অনেক লোক বিনিয়োগ করে।তারপর এক সময় ব্যপক দরপতনের মাধ্যমেসাধারণ বিনিয়োগকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আর প্রতারকরা লাভবান হয়। শেয়ার বাজারে এ ধরনের স্ক্যাম বাংলাদেশেই হয়েছে যেখানে পথে বসেছে অনেক মানুষ। বাংলাদেশে সিমানা পিলার, পুরাতন কয়েন সহ যত ধরনের সাধারণমহামূল্যবান জিনিসের গোপন বিজনসেরে কথা শোনা যায় এগুলো সব পাম্প এন্ড ডাম্প প্রতারণা। এ কারণে যে কোনো অস্বাভাবিক ফিনানশিয়াল গেইনে আকৃষ্ট না হয়ে যাচাই করে দেখতে হবে।
নলেজ স্কীম: ফেসবুকে ইদানিং বিজ্ঞাপন দেখা যায় কীভাবে মাসের মধ্যে হাজার হাজার ডলার আয় করা সম্ভব । নির্দিষ্ট কৌশল শিখে দিনে মাত্র ২ ঘন্টা কাজ করে মাসে ৪-৫ হাজার ডলার আয় করার সুযোগ। ড. এ্যলেক্স আপনাকে এমন কোর্স শেখাবে যা দিয়ে প্রায় পরিশ্রম ছাড়াই ডলার আয় করা সম্ভাব। এটা হলো অর্থনৈতিক প্রতারণার সাম্প্রতিক কৌশল। মানুষ সহজাতভাবে কম পরিশ্রমে প্রচুর টাকা আয় করতে চায় । ফলে এ ধরনের বিজ্ঞাপনের কৌশলে আকৃষ্ট হয়ে সে নলেজ নেয়ার চেষ্টা করে প্রতারিত হয়। নলেজ স্কীমের আরেকটা বৈশিষ্ট হলো,যে জিনিসটা শেখানো হবে সেটা খুব সহজ হবে, যেমন সামান্য কয়কেটা স্লাইড দেখলেই সিক্রেট জেনে যাবেন, এটাও মানুষকে আকৃষ্ট করার কৌশল। এমনকি এসব স্কীমের কারণে মানুষ দীর্ঘ সময় অধ্যাবসায়ের পরে কোনো একটা সেক্টরে দক্ষ হওয়ার প্রবণতা কমে শর্টকার্টের প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ে।
প্রচুর অর্থের জন্য অগ্রীম সামান্য অর্থ প্রদান: শতবর্ষ আগে থেকেই এই প্রতারণার শুরু। আগে কোনো বিখ্যাত লোকের নামে চিঠি আসত যে তার আপাতত একটা সমস্যার জন্য সামান্য কিছু টাকা দিলে আপনাকে পরবর্তিতে প্রচুর টাকা দেওয়া হবে। ইদানিং ইমেইলে এরকম ম্যাসজে পাওয়া যায় , সিরিয়া বা লিবিয়ার কোনো বন্দি প্রিন্স তার মিলিয়ন ডলার আপনার ব্যাংক এ্যাকাউন্টে জমা দিয়ে এদেশে পালিয়ে এসে পরে সুযোগমতো অনত্র চলে যেতে চায়। কিন্তু তার আইনজীবীর জন্য ৫০০-১০০ডলার দিতে হবে এখন যা সে দিতে পারছে না, আপনাকে তার বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়েছে, টাকাটা দিলে পরে তার মিলিয়ন ডলার থেকে ১-২ লাখ ডলার দেবে। অথবা ফেসুবুকে পরিচয় হয়ে কিছুদির পর গিফট পাঠালো, পরে কাস্টম থেকে জানানো হলো এর মধ্যে তো ডলার আছে। কাস্টম ক্লিয়ারেন্স করাতে ৪-৫ লাখ টাকা জমা দিতে হবে ব্যাংকে। লোভে পড়ে টাকা জমা দিলো ব্যংকে তারপর এক সময় বুঝতে পারলো প্রতারণা।
যে কোনো স্ক্যাম প্রথম দিকে বেশ সাফল্য নিয়ে আসে। কিন্তু এগুলো এক সময় ভেঙে পড়ে। তথ্যপ্রযুক্তির কল্যাণে তথ্য মানুষের হাতের মধ্যে এসেছে। প্রতারকরা এটাকেই কাজে লাগিয়েছে। ২০১৫ সাল থেকে ২০১৭ সালে ড. রুজা নামের এক সুন্দরী মহিলা OnCoinনামে একটি ক্রিপ্টোকারেন্সি বাজারে নিয়ে আসে যা বিকয়েনকে ছাড়িয়ে যাবে এমন চটকদার কথা বলে ১৭০টি দেশের লাখ লাখ মানুষের ৪ বিলিয়ন ডলার নিয়ে পালিয়ে যায়। ঐ সময়ে অনেক সতর্ক করা হয়েছিল, বারবার বলা হয়েছিল এটা স্ক্যাম। তারপরেও মানুষকে ফেরানো যায়নি মানুষের দ্রুত বড়লোক হওয়ার লোভের কারণে।
অবস্থা এখন এমন হয়েছে যে আমাদের পাশেই দাঁড়িয়ে আছে অদৃশ্য প্রতারক। নানা কায়দায় প্রতিনিয়ত প্রতারণার ফাঁদ পেতে চলছে এরা। সাধারণত সহজ-সরল মানুষই তাদের প্রধান লক্ষ্য। সুযোগ বুঝেই নানা ছলচাতুরি ও মিথ্যা প্রলোভন দেখিয়ে তারা প্রতারণা করছে। এসব প্রতারণার মধ্যে কম খরচে বিদেশ পাঠানো, বিকাশ বা মোবাইল ফোনে বড়ো পুরস্কার জেতা, জাদুর বাক্সে টাকাকে ডলারে রূপান্তর, অনলাইনে বিনিয়োগ করে দ্রুত অধিক মুনাফা অর্জন ও ভাগ্য পরিবর্তন ইত্যাদি । এদের খপ্পর থেকে বাঁচার একমাত্র মাধ্যম হচ্ছে, সচেতন থাকা ও লোভ পরিহার করা।তাই সবাইকে জানতে,বুঝতে এবং লোভ সংবরন করতে হবে। এছাড়াও দুর্বল পাসওয়ার্ড ব্যবহার থেকে বিরত থাকতে হবে। পাসওয়ার্ড ১৪ থেকে ১৬ অঙ্কের হতে হবে। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছ থেকে আসা লেনদেন সংক্রান্ত বার্তা ভালোভাবে খেয়াল রাখতে হবে।
পিআইডি ফিচার
উপদেষ্টা সম্পাদক : মো. রেজাউল ওয়াদুদ চেয়ারম্যান বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন পরিষদ (বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস এনফোর্সমেন্ট কাউন্সিল)
সম্পাদক ও প্রকাশক মো: আবু বক্কর তালুকদার
ব্যবস্থাপনা সম্পাদক : নূরুদ্দীন রাসেল
অফিস : ৩৭০/৩,কলেজ রোড,আমতলা, আশকোনা,ঢাকা-১২৩০,
Call : 01911120520
Email : info.sylhet24express@gmail.com
Design and developed by Web Nest