প্রকাশিত: ৯:০৯ অপরাহ্ণ, এপ্রিল ২১, ২০২৫
মো. মামুন অর রশিদ : কোনো রাজনৈতিক দলের বিবেকবান কট্টর সমর্থকও তাঁর দলের বিপক্ষে যাওয়া ঘটনার পক্ষপাতহীন সংবাদ গণমাধ্যমে দেখতে চান। গণমাধ্যমে সবসময় প্রকৃত সত্য উঠে আসবে, এটিই প্রত্যাশিত। তবে গণমাধ্যমে সমাজের পক্ষপাতহীন চিত্র তুলে ধরা মোটেও সহজ কাজ নয়। এর সঙ্গে অনেকগুলো বিষয় জড়িত। গণমাধ্যমের প্রধান অংশীজন হলো সাংবাদিক। সাংবাদিক নিরপেক্ষ, চাপমুক্ত ও পেশাদার না হলে, তাঁর পক্ষে কোনো ঘটনার সত্য বিবরণী প্রকাশ করা সম্ভব নয়। দুঃখজনক হলেও সত্য, বাংলাদেশে এখনো সাংবাদিকতা পেশাটি স্বাধীন কিংবা চাপমুক্ত হতে পারেনি। এখনো পেশাগত কর্মে নিয়োজিত সাংবাদিকগণ প্রায়শ সহিংসতা, হুমকি ও হয়রানির শিকার হচ্ছেন। বিষয়টি বিবেচনা করে গণমাধ্যম সংস্কার কমিশন ‘সাংবাদিকতার অধিকার সুরক্ষা অধ্যাদেশ, ২০২৫’ জারির প্রস্তাব করেছে। কমিশন স্বপ্রণোদিত হয়ে এই অধ্যাদেশের খসড়াও কমিশনের প্রতিবেদনে সংযুক্ত করেছে। সাংবাদিকতা সুরক্ষা আইন কেন প্রয়োজন— তার সুনির্দিষ্ট কারণ উঠে এসেছে গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে।
বস্তুনিষ্ঠ তথ্য প্রকাশ এবং বাক্স্বাধীনতার অধিকার চর্চার কারণে বিভিন্ন সময় বাংলাদেশের সাংবাদিকদের হয়রানি ও শারীরিক আক্রমণের শিকার হতে হয়েছে। সাংবাদিকদের পেশাগত কাজে বাধা দিতে হুমকি, ভীতিপ্রদর্শন, আইনগত হয়রানির মতো ঘটনা প্রায়শ ঘটছে। এসব বেআইনি কার্যক্রম স্বাধীন সাংবাদিকতাকে মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্ত করে। ক্ষমতাসীন দলের সদস্য কিংবা প্রভাবশালীদের হুমকি ও হামলার ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী প্রায়ই কোনো সুরক্ষা দেয় না। আর যেখানে রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন সংস্থা বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য জড়িত থাকেন, সেখানে প্রশাসনও নিষ্ক্রিয় দর্শকের ভূমিকা পালন করে এবং আদালতেও প্রতিকার কিংবা সুরক্ষা মেলে না। গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে এসব আশঙ্কার কথা উঠে এসেছে। দুঃখজনক হলেও সত্য, হত্যার শিকার হওয়া সাংবাদিকদের অধিকাংশের পরিবারই বিচার পায়নি। এক যুগেরও বেশি সময় সাগর-রুনি দম্পতির বহুল আলোচিত হত্যাকাণ্ডের বিচার না হওয়ায় জনগণের মধ্যে ধারণা তৈরি হয়েছে যে, সাংবাদিকদের মারলে কিছুই হয় না।
গত দেড় দশকে সাংবাদিকরা তাঁদের অনলাইন ও অফলাইন রিপোর্টিংয়ের জন্য বিভিন্নভাবে যেমন আক্রমণের শিকার হয়েছেন, তেমনি গ্রেফতার ও মিথ্যা মামলায় জেলও খেটেছেন। আলোকচিত্র সাংবাদিক শফিকুল ইসলাম কাজল, সাংবাদিক-গবেষক মোবাশ্বের হাসান, সাংবাদিক গোলাম সারোয়ারসহ বেশ কয়েকজন সাংবাদিক বিভিন্ন মেয়াদে গুমের শিকার হয়েছেন। এছাড়া আড়ি পাতা প্রযুক্তির ব্যবহার ও নজরদারির কারণে সাংবাদিকদের ব্যক্তিগত গোপনীয়তার অধিকার মারাত্মকভাবে ক্ষুণ্ন হয়েছে। সাংবাদিকদের নিরাপত্তা প্রদান একটি বৈশ্বিক বিষয়। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সাংবাদিকদের আইনগত সুরক্ষা প্রদানে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে এবং হচ্ছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের মিডিয়া ফ্রিডম অ্যাক্ট এক্ষেত্রে উল্লেখ্য। এ আইনে গণমাধ্যম ও সাংবাদিকদের সঙ্গে পেশাগতভাবে সম্পর্কিত ব্যক্তিদের ওপর নজরদারি, বিশেষ করে গতিবিধি অনুসরণ ও ব্যক্তিগত যোগাযোগে আড়ি পাতা প্রযুক্তি ব্যবহারের বিরুদ্ধে সুরক্ষা দেওয়া হয়েছে। শ্রীলঙ্কার গণঅভ্যুত্থানপরবর্তী সরকার নতুন যে গণমাধ্যম নীতি গ্রহণ করছে তাতে শারীরিক, যৌন, মানসিক, মৌখিক লাঞ্ছনা (গালাগাল) এবং আইনগত হয়রানি থেকে সাংবাদিকদের সুরক্ষা পাওয়ার অধিকার স্বীকৃতি পেয়েছে। পাকিস্তানেও মিডিয়া ফ্রিডম প্রটেকশন অ্যাক্ট চূড়ান্ত হওয়ার পর পার্লামেন্টে পাশ হওয়ার অপেক্ষায় রয়েছে।
বিদ্যমান বাস্তবতায় বাংলাদেশেও সাংবাদিকতার অধিকার সুরক্ষা আইন অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। গণমাধ্যম সংস্কার কমিশন প্রস্তাবিত ‘সাংবাদিকতার অধিকার সুরক্ষা অধ্যাদেশ, ২০২৫’-এর ভিত্তি হলো সংবিধানের ৩২, ৩৯ ও ৪০ অনুচ্ছেদ। সংবিধানের ৩২ অনুচ্ছেদে জীবন ও ব্যক্তি স্বাধীনতার অধিকার রক্ষণ, ৩৯ অনুচ্ছেদে চিন্তা, বিবেক, বাক্ ও ভাবপ্রকাশের স্বাধীনতা এবং সংবাদপত্রের স্বাধীনতা এবং ৪০ অনুচ্ছেদে পেশা ও বৃত্তির স্বাধীনতা ও অধিকারের নিশ্চয়তা প্রদান করা হয়েছে। সাংবাদিকতার অধিকার সুরক্ষা অধ্যাদেশ, ২০২৫-এর খসড়া প্রস্তাবনায় মোট ধরা রয়েছে ২০টি। প্রস্তাবিত এই অধ্যাদেশকে আইনে পরিণত করা গেলে এটি গণমাধ্যমের স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠায় মাইলফলক হয়ে থাকবে। প্রস্তাবিত এই অধ্যাদেশে যেসব ধারা সংযুক্ত করা হয়েছে, তা সাংবাদিকতার অধিকার সুরক্ষায় কার্যকর ভূমিকা পালন করবে। কারা সাংবাদিক হিসেবে বিবেচিত হবেন, সে বিষয়টিও প্রস্তাবিত অধ্যাদেশে সুস্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। প্রস্তাবিত অধ্যাদেশে ‘সাংবাদিক/সংবাদকর্মী’ বলতে সার্বক্ষণিক সাংবাদিক; গণমাধ্যমের কাজে নিয়োজিত আছেন এমন কোনো সম্পাদক, সম্পাদকীয় লেখক, নিউজ এডিটর, উপ-সম্পাদক, সহ-সম্পাদক, ভিডিও এডিটর, ফিচার লেখক, রিপোর্টার, সংবাদদাতা; খণ্ডকালীন সাংবাদিক, ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক এবং বিদেশি গণমাধ্যমের প্রদায়ক হিসেবে কর্মরত সাংবাদিক; গণমাধ্যমের কাজে নিয়োজিত আছেন এমন কোনো কপি টেস্টার, কার্টুনিস্ট, সংবাদ চিত্রগ্রাহক, গ্রাফিক ডিজাইনার এবং নিবন্ধিত গণমাধ্যমের সংবাদকর্মে নিয়োজিত কর্মী-কে বুঝানো হয়েছে।
প্রস্তাবিত অধ্যাদেশের ৩ ধারায় বলা হয়েছে, প্রত্যেক সাংবাদিককে সহিংসতা, হুমকি ও হয়রানি হতে সুরক্ষা প্রদানের দায়িত্বে থাকবে উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ ও সরকার। দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্তৃপক্ষ ও সরকার যথাযথভাবে সাংবাদিকের সুরক্ষার বিষয়টি নিশ্চিত করবে। একই ধারায় আরও বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি এমন কোনো কর্মকাণ্ড করবেন না বা নিয়োজিত হবেন না, যা দ্বারা সাংবাদিকদের ব্যক্তিগত বা পেশাগত জীবন বা সম্পদের কোনোরূপ ক্ষতি হয়। নিবর্তনমূলক কোনো আইন বা বিধি দ্বারা সাংবাদিকদের ব্যক্তিগত বা পেশাগত জীবন বা সম্পদের নিরাপত্তা বিঘ্নিত না হয় কিংবা সাংবাদিকদের আইন বহির্ভূতভাবে গ্রেফতার বা আটক না করা হয়, সে বিষয়েও পদক্ষেপ গ্রহণের কথা এই ধরায় বলা হয়েছে।
প্রস্তাবিত অধ্যাদেশের ৪ ধারায় সাংবাদিকদের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা এবং গৃহ, পরিবার ও যোগাযোগের সকল মাধ্যম সুরক্ষিত রাখার অধিকারের কথা বলা হয়েছে। একই ধারায় আরও বলা হয়েছে, কেউ ভয়-ভীতির মাধ্যমে কিংবা জোরপূর্বক শারীরিক বা মানসিক চাপ প্রয়োগ করে সাংবাদিককে তথ্যসূত্র প্রকাশে বাধ্য করতে পারবেন না। প্রস্তাবিত অধ্যাদেশে সাংবাদিকদের স্বাধীনভাবে পেশাগত দায়িত্ব পালন-সম্পর্কিত বিধান অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। ৫ ধারায় বলা হয়েছে, পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে কোনো সাংবাদিক যেন সহিংসতা, হুমকি, হয়রানি এবং বিশেষত যৌন হয়রানির শিকার না হন, সে বিষয়ে উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ ও সরকার বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করবে। প্রস্তাবিত এই অধ্যাদেশে সরল বিশ্বাসে কৃতকর্মের জন্য সাংবাদিকদের সুরক্ষার অধিকার দেওয়া হয়েছে। যা নিঃসন্দেহে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণে সহায়ক হবে। অধ্যাদেশের ৭ ধারায় বলা হয়েছে, পেশাগত কর্মে নিয়োজিত কোনো সাংবাদিক যদি সরল বিশ্বাসে কোনো গণমাধ্যমে তথ্য, উপাত্ত, লিখিত বা অডিও বা ভিডিও প্রতিবেদন প্রকাশ করে এবং উক্ত প্রকাশের দ্বারা কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান বা সংস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হলে বা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকলে, ভিন্ন উদ্দেশ্য প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত, উক্ত সাংবাদিকের বিরুদ্ধে দেওয়ানি বা ফৌজদারি মামলা বা অন্য কোনো আইনগত কার্যধারা রুজু করা যাবে না।
৯ ধারায় কোনো সাংবাদিকের বিরুদ্ধে সহিংসতা, হুমকি ও হয়রানিকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে অপরাধের মাত্রা অনুযায়ী অভিযুক্ত ব্যক্তি অন্যূন এক বছরের কারাদণ্ড বা অনূর্ধ্ব পাঁচ বছরের কারাদণ্ড বা অন্যূন এক লক্ষ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। ১০ ধারায় অর্থদণ্ডকে ক্ষতিপূরণ হিসেবে সাংবাদিককে দেওয়ার বিধানও রাখা হয়েছে। অধ্যাদেশে মিথ্যা অভিযোগকারীকে শাস্তির আওতায় আনার বিধান অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। ১৫ ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো সাংবাদিক আইনানুগ কারণ না থাকা সত্ত্বেও অন্য কোনো ব্যক্তির ক্ষতিসাধনের উদ্দেশ্যে অভিযোগ করেন, তাহলে তিনি অনধিক এক বছরের কারাদণ্ড অথবা ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। প্রস্তাবিত এই অধ্যাদেশে অভিযোগ দায়েরের পদ্ধতি, বিচার ও তদন্ত প্রক্রিয়া সম্পর্কেও বলা হয়েছে। তবে, সাংবাদিক পরিচয়ের অপব্যবহার এবং পেশাবহির্ভূত কোনো অপরাধমূলক কাজের ক্ষেত্রে সাংবাদিকদের কোনো সুরক্ষার সুযোগ থাকবে না।
পেশাগত কাজে সাংবাদিকদের সুরক্ষা প্রদান গণমাধ্যমের স্বাধীনতার অন্যতম পূর্বশর্ত। এজন্য সাংবাদিকদের সুরক্ষা প্রদানের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট আইন থাকা উচিত। গণমাধ্যম-সংশ্লিষ্টদের প্রত্যাশা, সরকার দ্রুত সাংবাদিকতার অধিকার সুরক্ষা-সংক্রান্ত অধ্যাদেশ জারি করবে এবং জাতীয় সংসদের আগামী অধিবেশনে এটি আইন হিসাবে পাশ হবে।
লেখক : জনসংযোগ কর্মকর্তা পদে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ে কর্মরত।
পিআইডি ফিচার।




অফিস : ৩৭০/৩,কলেজ রোড,আমতলা, আশকোনা,ঢাকা-১২৩০,
Call : 01911120520
Email : info.sylhet24express@gmail.com
প্রধান উপদেষ্টা : আলহাজ্ব মোহাম্মদ কাপ্তান হোসেন
পরিচালক, সিলেট উইমেন্স মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও প্রতিষ্ঠাতা, আলহাজ্ব মোহাম্মদ কাপ্তান হোসেন সমাজ কল্যাণ ট্রাস্ট।
উপদেষ্টা সম্পাদক : মো. রেজাউল ওয়াদুদ চেয়ারম্যান বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন পরিষদ (বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস এনফোর্সমেন্ট কাউন্সিল)
সম্পাদক ও প্রকাশক মো: আবু বক্কর তালুকদার
ব্যবস্থাপনা সম্পাদক : নূরুদ্দীন রাসেল
Design and developed by Web Nest