এবারের মেসি যে কারণে আলাদা

প্রকাশিত: ১২:৪৩ অপরাহ্ণ, ডিসেম্বর ১৭, ২০২২

এবারের মেসি যে কারণে আলাদা

স্পোর্টস ডেস্ক : অধরা বিশ্বকাপ ছুঁয়ে দেখা থেকে মাত্র এক ম্যাচ দূরে দাঁড়িয়ে লিওনেল মেসি। অবিশ্বাস্য ক্যারিয়ারে এই শিরোপাটিই এখনও ছুঁয়ে দেখা হয়নি আর্জেন্টাইন ফরোয়ার্ডের।

 

কিন্তু এবার কাতারে বিশ্বকাপ শুরুর আগে তার ওপর ভরসা পাচ্ছিলেন না খোদ আর্জেন্টাইন সমর্থকরাই। কারণ পিএসজির জার্সিতে তার মলিন পারফরম্যান্স। তবে সব শঙ্কা দূরে ঠেলে দলের প্রাণভোমরা হয়েই ফিরেছেন এই পিএসজি তারকা। কীভাবে সম্ভব হলো এমনটা?

 

বার্সেলোনা ছেড়ে গত মৌসুমের আগে যখন মেসি পিএসজিতে গেলেন, অনেকে ধরেই নিয়েছিলেন তার ক্যারিয়ার শেষ। প্যারিসে নিজের প্রথম মৌসুমটাও কেটেছে তার ভুলে যাওয়ার মতোই। ফলে তাকে ঘিরে শঙ্কার মেঘ জমে গিয়েছিল। দ্বিতীয় মৌসুমে অবশ্য নিজেকে অনেকটাই ফিরে পেয়েছেন তিনি। কিন্তু সেই ‘বার্সার মেসি’ যেন আড়ালেই চলে গিয়েছিলেন। তবে জাতীয় দলে তিনি ছিলেন আগের মতোই।

 

 

কাতারে বিশ্বকাপ শুরু হওয়ার পর নিজেদের প্রথম ম্যাচেই সৌদি আরবের কাছে হেরে বসে আর্জেন্টিনা। তখনই সমর্থকরা প্রমাদ গুনতে শুরু করেন- মেসির স্বপ্ন হয়তো এবারও অধরাই থেকে যাচ্ছে। কিন্তু খাদের কিনার থেকে ঘুরে দাঁড়ানো কাকে বলে মেসি তা চোখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছেন। নিজে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে দলকে তুলে এনেছেন আসরের ফাইনালে। পরের প্রতি ম্যাচেই দলের জয়ে রেখেছেন গুরুত্বপূর্ণ অবদান।

 

 

আগের চেয়ে বেশি গোল
সৌদি ম্যাচের পর থেকে মেসির ফর্মে যে পরিবর্তন এসেছে তা রীতিমত আশ্চর্যজনক। এখন পর্যন্ত এ আসরে ৬ ম্যাচে ৫ গোল করেছেন তিনি (২০১৪ বিশ্বকাপে করেছিলেন ৪ গোল)। এর মধ্যে ৩টি আবার পেনাল্টি থেকে। সবমিলিয়ে বিশ্বকাপে তার মোট গোলসংখ্যা এখন ১১টি। এরইমধ্যে আর্জেন্টিনার জার্সিতে বিশ্বকাপে সবচেয়ে বেশি গোলের (১১টি) রেকর্ড নিজের করে নিয়েছেন মেসি।

 

 

আরও বেশি অ্যাসিস্ট
কাতার বিশ্বকাপে এখন পর্যন্ত ৬ ম্যাচে ৩টি অ্যাসিস্ট করেছেন মেসি। এর সর্বশেষটি এসেছে সেমিফাইনালে ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষে। তরুণ সতীর্থ হুলিয়ান আলভারেসকে দিয়ে তিনি যে গোলটি করিয়েছেন, তা অনেকের মতে বিশ্বকাপে সেরা অ্যাসিস্ট। ৩৫ বছর বয়সেও এভাবে দৌড়ানো এবং ড্রিবল করা অনেকের চোখেই অবিশ্বাস্য। বিশ্বকাপে এখন পর্যন্ত মেসির মোট অ্যাসিস্ট ৮টি; তার সমান অ্যাসিস্ট আছে শুধু কিংবদন্তি দিয়েগো ম্যারাডোনার।

 

 

পারফরম্যান্সের বিচারেও এগিয়ে
গোল করা ছাড়াও আর্জেন্টিনার প্রতিটি ম্যাচেই মূল ভূমিকা রাখছেন মেসি। শুধু আর্জেন্টিনা কেন, এ বিশ্বকাপের বাকি সবার চেয়েও পারফরম্যান্সের বিচারে এগিয়ে তিনি। যদিও ফাইনালে ফ্রান্সকে মোকাবিলা করতে হবে আলবিসেলেস্তেদের। গতবারের চ্যাম্পিয়নদের সঙ্গে লড়াই মোটেই সহজ হবে না মেসিদের জন্য। কিন্তু মেসির জন্য এটাই সবচেয়ে বড় উপলক্ষ নিজের ‘গ্রেটনেস’ প্রমাণের।

 

 

পরিণত নেতৃত্ব
মেসি যে অধিনায়ক হিসেবে আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে অনেক পরিণত তা অস্বীকার করার উপায় নেই বললেই চলে। শুধু মাঠে কেন, মাঠের বাইরেও দলকে একতাবদ্ধ রাখার কঠিন কাজটি করে চলেছেন তিনি। দলটির প্রতি তার নিবেদন এতটাই যে, বাকি সদস্যরা শুধু মেসির জন্যই বিশ্বকাপ জিততে মরিয়া। প্রতি ম্যাচ শেষে সংবাদমাধ্যমের মুখোমুখি হচ্ছেন তিনি। সৌদি ম্যাচের পর নিজেকে শান্ত রেখে ঠাণ্ডা মেজাজে সব সামলে নিয়েছেন তিনি। আবার নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে তার ভূমিকা দেখেও অনুমান করা যায়, দলের জন্য আগ্রাসী ভূমিকা নিতেও ঘাবড়াবেন না তিনি।

 

 

শারীরিক বুদ্ধিমত্তা

মেসির বয়স ৩৫ বছর। ফলে এখন আর আগের মতো শারীরিক পরিশ্রম করা তার পক্ষে সম্ভব নয়। মাঠের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে দৌড়ে যাওয়ার শক্তি অবশিষ্ট নেই। এ কারণে এবার শারীরিক বুদ্ধিমত্তার দিকে জোর দিচ্ছেন তিনি। শুধু শুধু দৌড়ানোও তাই থামিয়ে দিয়েছেন মেসি। আক্রমণভাগে সুযোগের অপেক্ষায় থাকছেন তিনি, বল পাওয়া মাত্র হানা দিচ্ছেন প্রতিপক্ষের বক্সে। এর ফলও মিলছে হাতেনাতে। এবারের বিশ্বকাপে এখন পর্যন্ত কোনো প্রকার ইনজুরি তাকে কাবু করতে পারেনি।

 

 

শিরোপা জেতার জেদ

এখন পর্যন্ত বিশ্বকাপ জিততে পারেননি মেসি। কিন্তু তার ইচ্ছাশক্তি তাতে মোটেও কমে যায়নি। বরং জেতার ক্ষুধা বা তাড়নায় কোনো ভাঁটা পড়েনি। এজন্য জাতীয় দলের জার্সিতে কোনো ম্যাচ মিস করতেও চান না তিনি। আগামীকাল ফ্রান্সের বিপক্ষে মাঠে নামার সময় বিশ্বকাপে তার মোট ম্যাচসংখ্যা হবে ২৬টি, যা একটি রেকর্ড। সেমিফাইনালে খেলতে নেমে তিনি ছুঁয়ে ফেলেছিলেন জার্মান কিংবদন্তি লোথার ম্যাথাউসের কীর্তি (২৫ ম্যাচ)।

 

 

এছাড়া ইতালিয়ান কিংবদন্তি পাওলো মালদিনিকে ছাড়িয়ে বিশ্বকাপে সবচেয়ে বেশি সময় খেলার রেকর্ডও নিজের করে নেবেন মেসি। বিশ্বকাপে মালদিনি মোট ২২১৭ মিনিট মাঠে ছিলেন। মেসির ক্ষেত্রে যা ২১৯৪ মিনিট। অর্থাৎ ফাইনালে প্রথমার্ধ পর্যন্ত খেললেও মালদিনিকে ছাড়িয়ে যাবেন মেসি।

 

 

দলের হয়ে গোলের খাতা খোলা

গোল করার দিক থেকে মেসি এবার সবার চেয়ে এগিয়ে। কিন্তু যে বিষয়টি অবাক করার মতো, তা হলো প্রায় প্রতি ম্যাচেই দলের প্রথম গোলটি তার পা থেকেই এসেছে। ৫ গোলের ৪টি গোল তিনি এভাবেই করেছেন। দল যখন বেকায়দায়, ঠিক তখনই তার জাদুর দেখা মিলছে। এমনকি সৌদির বিপক্ষে দলের হয়ে গোলের খাতা খুলেছিলেন তিনি। যদিও ওই ম্যাচটি রক্ষণের ব্যর্থতায় হেরে যায় আর্জেন্টিনা। কিন্তু এরপর আর এমনকিছু হয়নি।

 

 

সমর্থকদের সঙ্গে দারুণ সম্পর্ক

আর্জেন্টিনার সমর্থকদের সঙ্গে মেসির সম্পর্ক অনেকটাই আত্মিক। কিন্তু দলের ফলাফলের ওপর নির্ভর করে এই সম্পর্কে বদল আসে। বিশেষ করে আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ ব্যর্থতার দায় অধিকাংশ সময় তার কাঁধেই চাপানো হয়। এমনকি অভিমান করে অবসরের ঘোষণাও দিয়ে ফেলেছিলেন মেসি। কিন্তু সেই সমর্থকদের চাপেই আবার ফিরে এসেছেন। ২০১৪-এর পর আরও একবার আলবিসেলেস্তেদের স্বপ্ন দেখাচ্ছেন তিনি। সেবার পারেননি, এবার পারবেন তো? এক ম্যাচ পরেই তা জানা যাবে। সমর্থকরাও অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় সেই মুহূর্তের যখন শিরোপা জিতে আর্জেন্টিনায় ফিরবেন সময়ের অন্যতম সেরা এই তারকা ফুটবলার।

 

 

কাতার বিশ্বকাপের মাঝপথ থেকেই ফুটবলবিশ্বের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু মেসি। যদিও তার হাতে সবাই যে বিশ্বকাপ দেখতে চায়, এমন নয়। কিন্তু তার অবিশ্বাস্য ক্যারিয়ারের প্রশংসা না করে উপায়ও নেই। একটা ফুটবলপ্রেমী প্রজন্ম তার খেলা দেখে বেড়ে ওঠেছে। এজন্য তাকে অপছন্দ করেন, এমন লোকজনও তার হাতে বিশ্বকাপ দেখতে চান।