গুজবসচেতন সন্তান চাই

প্রকাশিত: ১২:৩৭ অপরাহ্ণ, ফেব্রুয়ারি ১২, ২০২৩

গুজবসচেতন সন্তান চাই

নাসরীন মুস্তাফা : ভুয়া তথ্য, মিথ্যে তথ্য, তথ্যের ঘাটতি দিয়ে বানানো কু তথ্যকে গুজব বানিয়ে ভাইরাল করার নেশা কুচক্রিদের কাছ থেকে শিশু কিশোরদের মাঝেও ছড়িয়ে পড়–ক, এ নিশ্চয়ই আমরা চাই না। এখনকার শিশু কিশোরদের কাছে ইন্টারনেটের জগত কত সহজেই না উন্মুক্ত করে রেখেছি।

 

অপরিচিত মানুষের সাথে মিশো না, এ কথা মুখে বললেও দিব্যি আদরের সন্তানকে অন্তর্জালের অপরিচিত অজানা জগতে ছেড়ে দিচ্ছি একা আর ভাবছি স্মার্ট হয়ে উঠছে সে! ডিভাইস টিপতে পারা স্মার্ট সন্তানকে সচেতন বানানোর কাজটি করতে হবে এবং এই কাজটি মাদক থেকে দূরে থাকার সচেতনা সৃষ্টির মতোই খুব জরুরি ও গুরুত্বপূর্ণ।

 

ভেবে দেখুন, দিনের বেশিরভাগ সময় সন্তানরা কম্পিউটার, মোবাইল ফোন আর ট্যাবলেটে সময় কাটাচ্ছে। অনেক জরুরি ও গুরুত্বপূর্ণ কাজের হাতিয়ার এগুলো। লেখাপড়ার উপকরণ চোখের পলকে মিলে যায়। কোডিং শিখে ফেলা, অন্য ভাষা শিখে ফেলা এখন ওদের কাছে পানির মতো সহজ বিষয়।

 

এর সাথে সাথে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে, অনলাইন গেমস আর ভিডিও শেয়ারিং প্ল্যাটফর্মে কত কত অসত্য বা মিথ্যে বা ভুয়া তথ্য গুজবের আকারে ওর মস্তিষ্কে পৌঁছে যাচ্ছে, সেটাও আমাদের দরকার মা-বাবা হিসেবে সর্বোচ্চ ক্ষমতা প্রদর্শন করে সন্তানকে ডিজিটাল দুনিয়া থেকে সরিয়ে আনবেন? পারবেন কি? পারার দরকারই বা কি। এর চেয়ে গুজবসচেতন সন্তান হিসেবে ওকে গড়ে তোলা দরকার। কেননা, এই গুজবে ভরপুর পৃথিবীতে সুস্থ-স্বাভাবিক মানুষ হিসেবে টিকে থাকতে ওকে কিন্তু একলা একা লড়াই করতে হবে।

 

‘গোয়েন্দা’ চরিত্র শিশু কিশোরদের দারুণ পছন্দের। সন্তানকে ‘গোয়েন্দা’ হতে বলুন, দেখবেন সানন্দে রাজি হবে। এই গোয়েন্দা সত্যের চিপায় লুকিয়ে থাকা মিথ্যে গুজব খুঁজে বের করতে পারে। সন্তানকে বলুন, গোয়েন্দা হতে হলে ওকে জানতে হবে- ভুয়া তথ্য কি ও কত প্রকার, ভুয়া তথ্য চেনার উপায়, ভুয়া তথ্য চেনা ও বিশ্বাস না করা কেনো জরুরি ইত্যাদি।

 

গোয়েন্দা দারুণ বুদ্ধিমান। প্রথমেই প্রশ্ন করবে, গুজব বানায় কারা? কী লাভ গুজব বানিয়ে? এর উত্তরে অর্থই সকল অনর্থের মূল, এ কথা খোলাখুলিভাবে বলতেই হবে। অর্থলোভী সুবিধাভোগী কুচক্রিদের হাতিয়ার গুজব। এরা কখনো একা, কখনো দলবদ্ধ। গুজব এরা নিজেরা বানায় অথবা গুজব বানাতে পারদর্শী কাউকে দিয়ে বানায়। গুজব বানিয়ে প্রচুর অর্থ হাতিয়ে নেওয়া যায়। বিজ্ঞাপন আকারে অর্থ মেলে।

 

ভিডিও কনটেন্ট বানিয়ে মানুষ দেখলে দর্শকের সংখ্যা গুণে অর্থ জোটে। অর্থের বিনিময়ে কোনো নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর বিশ্বাস বা মতাদর্শের প্রচার করা যায়, যাতে তারা অনুসারী পায় বেশি বেশি। যত অনুসারী তত পেশিশক্তি, তত ভয় কুড়ানো আর যার প্রতি ভয়ের পাল্লা বেশি তার পায়ে অর্ঘ্যদানও বেশি বেশি। ভুয়া তথ্য বিনোদনের শক্ত মাধ্যমও বটে।

 

এই সব রসাতলে গেল কিংবা বাংলাদেশ শ্রীলংকা হয়ে গেল টাইপের খবরে মস্তিষ্কে উত্তেজনার প্রবাহ পেতে আনন্দ পায়, এমন মানসিক বিকারগ্রস্থ মানুষের সংখ্যা কিন্তু কম নয়। আর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিজের মত প্রকাশের স্বাধীনতায় কত কথাই না বলছি। নিজের কথা, নিজের বিশ্বাস, নিজের মতাদর্শ অন্যকে জানিয়ে বা শুনিয়ে বিপুল আনন্দ দেয়। সে কথা সব সত্য না হলেও শোনাতে ইচ্ছে হয়।

 

এভাবেই তৈরি করছি গুজব। গোয়েন্দা এবার জানুক গুজব বানানোর হাতিয়ার কী কী। সত্য কথার ভাত নেই, এমন কথা আমরা বড়োরা হরহামেশাই বলি। সন্তানরাও নিজের অবচেতনে বুঝে নেয়, মিথ্যে কথাই বেশি শক্তিশালী। মিথ্যে আবার পুরোপুরি মিথ্যে নয়। সত্যের সাথে মিশিয়ে বললে বেশি পোক্ত হয়।

 

সত্য পুরোপুরি না বলে কিছু তথ্য লুকিয়ে ফেললে বা উদ্দেশ্যমূলক সত্য তথ্য ঢুকিয়ে দিলেও কিন্তু কেল্লা ফতে। সত্য প্রকাশে অনড় অটল পত্রপত্রিকাগুলো এরকম হরহামেশাই করছে। এরপর কৌশলী প্রচারণায় দলভুক্ত ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে দিয়ে বারবার প্রচার করতে হবে, আমি যাহা বলিয়াছি তাহাই পূর্ণ সত্য। জেনে বুঝে তথ্যের ঘাটতি করেও গুজব বানানো যায়। কারোর সুনাম ক্ষুণ করতে, কোনো প্রতিষ্ঠানকে ধসিয়ে দিতে সব তথ্য না বলে কিছু তথ্য উদ্দেশ্যপূর্ণভাবে গায়েব করে ফেলা হয়। ক্ষুব্ধ পক্ষ এরপর মানহানির মামলা করতে পারেন, তবে ততদিনে মানের ক্ষতি কিন্তু হয়েই গেল। আর মানুষ সব সময় নেতিবাচক তথ্য গ্রহণ করে বেশি।

 

গোয়েন্দাদের ম্যাগনিফাইং গস্নাস থাকে, থাকে যে কোনো ঘটনাকে ভিন্নদৃষ্টিতে দেখার ও সমস্যা সমাধানে ভিন্নভাবে চিন্তা করার ক্ষমতা। ভুয়া তথ্য সনাক্ত করার কিছু উপায় জেনে ফেলবে প্রিয় গোয়েন্দা। যেমন- বাক্যে প্রনাউন বা সর্বনামের ব্যবহার, পরিসংখ্যান, তারিখে গন্ডগোল ইত্যাদি ‘এরর’ টের পেতে হবে। আর উচ্চারণে অপেশাদারীত্ব, আঞ্চলিকতা, অশুদ্ধতা বুঝতে কান হতে হবে সজাগ।

 

বুঝতে হবে, যা বলা হচ্ছে তা কি ঠাট্টা করে বলছে, বিজ্ঞাপন হিসেবে বলছে না কি সত্য হিসেবে সিরিয়াসলি বলা হচ্ছে। না বুঝে বা বুঝে এরকম অনেক ঠাট্টা ও বিজ্ঞাপন জাতীয়-আন্তর্জাতিক পর্যায়েও গুজব আকারে ছড়িয়ে পড়ে, চিলের কান নিয়ে যাওয়ার মতো। গুজবে কান দেওয়া ‘জোকার’ হতে চায় কে? বিনা স্বার্থে কেউ চায় না। তারিখে গন্ডগোলের বিষয়টা আরেকটু বাড়িয়ে বলি। গরমের ওয়াজ শীতকালে দিতে হয় না যেমন, তেমনি বসন্তকালে ঢাকার প্রাণকেন্দ্রে বরফ পড়ছে জাতীয় খবর বিশ্বাসযোগ্য নয়। তেমনি বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দাকালে বাড়ির পাশের বাজারে জিনিসের দাম চড়ে গেলে মাথা একটু কম গরম করে নিজের খাবারে বিকল্প খুঁজতে হবে।

 

ভুয়া খবরের নির্ভরযোগ্য উৎস খুঁজে পাওয়া যায় না, জানতে হবে তাকে। প্রায়ই বাংলাদেশ নিয়ে ‘এইমাত্র পাওয়া’ ভয়াবহ খবরের ডিজিটাল কনটেন্ট চোখে পড়ে, যেখানে ভয়াবহ বিজ্ঞ বক্তা নির্দিষ্ট উৎস না বলে তিনি শুনেছেন জানিয়ে শোনা কথা অন্যকে জানানোর দায়িত্ব পালন করতে তৎপর হন দেখেছি। ঘটনা যার সাথে ঘটেছে, যেখানে ঘটেছে বা ঘটতে যাচ্ছে, সে সম্পর্কিত নির্ভরযোগ্য দায়িত্বশীল তথ্যসূত্র না থাকলে সে তথ্য অবশ্যই গুজব। অন্যের কাছ থেকে শোনা তথ্য কখনো প্রাইমারি সূত্রের সমান মূল্যবান হতে পারে না।

 

ভুয়া ওয়েবসাইট থেকে ভুয়া তথ্য মেলে, এই সঠিক ও জরুরি তথ্যটি সন্তানকে গোয়েন্দা হয়ে উঠতে সাহায্য করবে। ভুয়া তথ্য মূলধারার উৎসে খুঁজতে গেলে পাওয়া যাবে না। এমন ভাব, এক্সক্লুসিভ এই তথ্য কেবল অমুকই জানে, এইমাত্র জেনেছে আর কি!

 

সত্য তথ্য সাধারণতঃ নির্মোহভাবে উপস্থাপিত হয়। ‘এইমাত্র পাওয়া’ টাইপের ডিজিটাল গুজবে আবেগের ছড়াছড়ি, চোখে-মুখে এমন ভাব ফুটিয়ে তোলা হয় যে দয়া করে বিশ্বাস করুন, নইলে আপনার সাথে সাথে আপনার দেশ-জাতি উচ্ছন্নে তথা শ্রীলংকা হয়ে যাবে। কদিন আগে একজনকে হাউমাউ করে কাঁদতেও দেখলাম, সাথে হাত-পা ছোঁড়াছুড়ি। ভিউ ছিল চুরানব্বই হাজার। এই কান্নাকাটি দেখে একজনও যদি তাকে বিশ্বাস করে ফেলে, সেটাও ক্ষতি।

 

মিথ্যের শক্তিকে প্রতিষ্ঠিত হতে দেওয়া ঠিক নয়, তা যত ক্ষুদ্র পরিমাণেই হোক না কেন। গুজবের বিষয়ের কোনো শেষ নেই। কার ছাদে ইউএফও নেমেছে বা কার সাথে এলিয়েনের দেখা হয়েছে জেনে গোয়েন্দা সন্তান শিহরিত হবে না। কেননা, সে খোঁজ নেবে বাড়ির ছাদটা এবং ব্যক্তিটা এলিয়েন বিশেষজ্ঞ কেউ কি না। রিজার্ভ নিয়ে কত রকমের তথ্যে সয়লাব ডিজিটাল দুনিয়া, এর ভেতরে রিজার্ভ বিশেষজ্ঞ ক’জন? সবাই রাতারাতি অর্থনীতিবিদ বনে গেলে বছরের পর বছর লেখাপড়া করে, গবেষণা করে অর্থনীতিবিদ হওয়ার দরকার আছে বলে মনে হয় না।

 

গুজবিয় সংবাদে ব্যবহৃত ছবি, ভিডিও বানানো হয়। অন্য সংবাদের, অন্য দেশের সংবাদের ছবি, ভিডিও চোখ বুঁজে চালিয়ে দেওয়া গুজবিয় অভ্যেস। আজকাল ছবি, ভিডিও, তথ্য ভুয়া কি না, তা ধরতে অনেক সফটওয়্যার এসে গেছে।

 

গোয়েন্দা সন্তান খোঁজ নিলেই জেনে ফেলবে এসব। হেডিং-এর সাথে ছবি ও ভিডিও’র মিল থাকে না প্রায়ই। হেডিং এর লোভে পড়ে তথ্য জানতে ক্লিক করলেই তো অর্থ মিলছে, নৈতিকতার প্রশ্ন করা যায় না কেননা গুজবের বিবেক নেই বলেই আমরা বিশ্বাস করি। আমরাও এও বিশ্বাস করি, যারে দেখতে নারি তার চলন সত্যি সত্যি বাঁকা না হলেও বাঁকা হিসেবে সৃষ্ট গুজব বিশ্বাস করতে আপত্তি নেই।

 

পক্ষপাতিত্ব মানুষের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। কাজেই তথ্য যিনি দিচ্ছেন, তার সঠিক সন্ধান করলেই বোঝা যায় তথ্যটি পক্ষপাতদুষ্ট কি না। আমাদের দেশে যেমন অতজন বুদ্ধিজীবীর স্বাক্ষরিত বিবৃতি বিষয়ক সংবাদে বিবৃতিদাতাদের নাম আগে দেখতে হয়, তাহলে বিবৃতিতে কী বলেছেন পুরোটা না পড়লেও বুঝে নেওয়া যায়।

 

আমরা জেনে গেছি, এরকম বিবৃতির বাইরে অমুক যাবেন না, আবার অমুক এরকম বিবৃতিতে আসবেনও না। এরকম বিবৃতিদাতা হয়ে বড়ো হয়ে উঠুক সন্তানরা, তা চাইতে পারেন না কোনো সচেতন অভিভাবক।