প্রধানমন্ত্রীর প্রটোকল কর্মকর্তা পরিচয়ে হরিদাসের যত প্রতারণা

প্রকাশিত: ১১:০৯ পূর্বাহ্ণ, নভেম্বর ৮, ২০২২

প্রধানমন্ত্রীর প্রটোকল কর্মকর্তা পরিচয়ে হরিদাসের যত প্রতারণা

অনলাইন ডেস্ক : শ্রী হরিদাস চন্দ্র তরনীদাস ওরফে তাওহীদ (৩৪) পেশাদায় এসি মেকানিক। কিন্তু তিনি নিজেকে পরিচয় দিতেন প্রধানমন্ত্রীর প্রটোকল কর্মকর্তা, মন্ত্রীর সহকারী আবার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা হিসেবে।

 

এসব পরিচয়ে বদলি বাণিজ্য, টেন্ডারবাজিসহ নানা প্রতারণা করতেন তিনি। আর এভাবেই সাধারণ মানুষের কাছ থেকে হাতিয়ে নিয়েছেন কোটি কোটি টাকা।

এ প্রতারক ভুক্তভোগীদের বিশ্বাস অর্জন করতে প্রধানমন্ত্রীর পরিবারের সদস্যদের নামে নিজ সহযোগীদের মোবাইল নম্বর সেভ করে রাখতেন।

 

মঙ্গলবার (৮ নভেম্বর) দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে র‍্যাবের মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান র‍্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।

 

এর আগে, সোমবার (৭ নভেম্বর) জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থা (এনএসআই) ও র‌্যাবের যৌথ অভিযানে রাজধানীর বনানী এলাকা থেকে এক সহযোগীসহ তাকে গ্রেফতার করা হয়।

 

এ সময় তাদের কাছ থেকে প্রতারণার কাজে ব্যবহৃত চারটি মোবাইল, জালিয়াতিতে ব্যবহৃত বিভিন্ন ডকুমেন্টস এবং প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে এডিট করা ভুয়া ছবি জব্দ করা হয়।

 

খন্দকার আল মঈন বলেন, প্রতারক হরিদাস ওরফে তাওহীদ প্রতারক চক্রের মূলহোতা। তিনি ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ার সময়ে অবৈধভাবে ভারতে এক আত্মীয়ের বাড়িতে আশ্রয় নেন। আত্মীয়ের মাধ্যমে সেখানকার পঞ্চায়েত প্রধানের কাছ থেকে কৌশলে একটি এতিম সার্টিফিকেট নিয়ে স্থানীয় একটি স্কুলে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক এবং ইলেক্ট্রনিক বিষয়ে দুই বছরের বিশেষ প্রশিক্ষণ নেন। পরবর্তীতে ২০১০ সালে বাংলাদেশে এসে রাজধানীর উত্তরায় পুরাতন এসি কেনা-বেচা ও মেরামত করে বিক্রির কাজ শুরু করেন। ২০১৮ সালে একজন সবজি বিক্রেতার সঙ্গে সাবলেট বাসা ভাড়া নেয় হরিদাস। বাসা ভাড়া থাকা অবস্থায় তার মেয়েকে বিয়ে করার জন্য ২০১৯ সালে সনাতন ধর্ম পরিবর্তন করে ধর্মান্তরিত হন তিনি। এরপর শ্রী হরিদাস চন্দ্র তরনীদাস নাম পরিবর্তন করে তাওহীদ ইসলাম নাম ধারণ করেন।

 

তিনি আরও বলেন, হরিদাস তার শ্বশুরের পরিচয়ে ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া এলাকায় কিছু জমি কেনেন। শ্বশুরের মাধ্যমে এলাকায় নিজেকে প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও বিত্তশালী হিসেবে পরিচয় দেয়। এ সময়ে প্রধানমন্ত্রীর পরিবারের সদস্যদের প্রটোকল অফিসার হিসেবেও পরিচয় দেন তিনি। তখন থেকে তিনি দামি গাড়ি এবং দামি পোশাক পরে মাঝে মধ্যে এলাকায় গিয়ে স্থানীয় রাজনীতিবিদ, গণ্যমান্য বিত্তশালী ব্যক্তিদের সঙ্গে পরিচিত হওয়া শুরু করেন এবং বিভিন্ন উন্নয়নমূলক প্রজেক্টের প্রস্তাব দিতেন। প্রজেক্টে বিনিয়োগ করলে তাদের লভ্যাংশ দেওয়া হবে বলেও জানাতেন। এছাড়াও প্রজেক্ট শুরু হলে সমাপ্ত করার জন্য প্রধানমন্ত্রীর পরিবারের সদস্যদের সহায়তায় বিভিন্ন সরকারি দপ্তর থেকে অর্থ নেওয়ার আশ্বাস দিতেন।

 

এসব ছাড়াও চাকরি, বদলি, টেন্ডারসহ বিভিন্ন বিষয়ে তদবির, জমি কেনা-বেচাসহ নানা প্রতিশ্রতি দিয়ে টাকা হাতিয়ে নিতেন তিনি।

 

আর তাওহীদের সহযোগী ইমরান নিজেকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মরত পরিচয় দিতেন। তিনি বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন মানুষকে হরিদাসের কাছে আনতেন। এরপর অধিদপ্তরের বিভিন্ন পদে চাকরি, পদোন্নতি এবং বদলির আশ্বাসে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নিতেন। হরিদাস অত্যন্ত বচনপটু। একবার তার সঙ্গে কেউ পরিচিত হলে তার প্রতারণার খপ্পর হতে বের হতে পারতেন না।

 

হরিদাসকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের বরাত দিতে খন্দকার মঈন জানান, প্রতারণার মাধ্যমে আয় করা টাকা দিয়ে ২০১৯ সালে ফুলবাড়িয়া এলাকায় প্রায় এক বিঘা জমি কিনে প্যারিস সুইমিংপুল এন্টারটেইনমেন্ট পার্ক নামে রিসোর্টের কাজ শুরু করেন হরিদাস। এ রিসোর্টের কাজ করার সময়ে আরও অনেকেই টাকা লেনদেনের রশিদ ছাড়া তাকে লাখ, লাখ টাকা দেয়। ২০২০ সালে প্রায় তিন কোটি টাকা ব্যয়ে রিসোর্টের কাজ শেষ হলে পরবর্তীতে ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে পর্যটকদের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। তার চক্রে পাঁচ থেকে ছয়জন সহযোগী রয়েছে। তাদের নম্বর হরিদাস মোবাইলে প্রধানমন্ত্রীর পরিবারের এবং নিকটাত্মীয়ের নামে সেভ করে রেখেছেন। তিনি নম্বরগুলোতে কল দিয়ে কথা বলে মানুষকে বোকা বানাতেন। সহজ সরল মানুষ এ নম্বরকেই প্রধানমন্ত্রীর পরিবারের সদস্যের নম্বর মনে করে প্রতারিত হতেন। প্রকৃতপক্ষে তার কোনো রাজনৈতিক নেতা বা কর্মীর সঙ্গে পরিচয় নেই। কোনো রাজনৈতিক পদও নেই তার। প্রতারণাই তার পেশা।

 

র‌্যাবের কর্মকর্তা মঈন জানান, হরিদাস চন্দ্র ২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে একটি ছবি এডিট করে তার ওয়ালপেপারে সংযুক্ত করে। তখন থেকেই প্রভাবশালী ব্যক্তিদের নাম ভাঙ্গিয়ে কিভাবে অর্থ উপার্জন করা যায় তার ফন্দিফিকির করতে থাকেন। একাধিক ব্যাংকে তার নামে-বেনামে বিভিন্ন অ্যাকাউন্ট রয়েছে। গোয়েন্দা সূত্রে এসব অ্যাকাউন্টগুলোতে কোটি কোটি টাকা লেনদেনের প্রমাণ পাওয়া গেছে। তিনি ফুলবাড়িয়া এবং বিভিন্ন এলাকায় বিভিন্ন পদে চাকরি দেওয়ার নাম করে শতাধিক লোকের কাছ থেকে কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। তার কাজে বাধা দেওয়ায় তিনি একজন স্থানীয় নেতাকে প্রকাশ্যে হত্যার হুমকিও দিয়েছেন।

 

হরিদাস বিভিন্ন সরকারি কার্যালয়ে টেন্ডারের বিষয়ে তদবীর করার জন্য প্রধানমন্ত্রীর পরিবারের পরিচয় দিয়ে ফোনালাপ করে টেন্ডারে অংশগ্রহণকারীদের কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নিতেন। যদিও কাউকে কাজ পাইয়ে দিতে সক্ষম হননি তিনি। স্বর্ণ চোরাচালান ও স্বর্ণের বারের অবৈধ বানিজ্যের সঙ্গেও হরিদাস জড়িত ছিলেন বলে গোয়েন্দা তথ্য রয়েছে।

 

তার সহযোগী গ্রেফতার ইমরান মেহেদী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ক্যাশিয়ার। তার নামেও রয়েছে নানাবিধ অপকর্মের রেকর্ড। প্রাইভেট ক্লিনিকে চাকরি দেওয়া, অনলাইনে নিবন্ধন আবেদন, নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠানের নবায়নসহ অর্থ জালিয়াতির বিভিন্ন অপকর্মে জড়িত থাকায় ২০২২ সালের প্রথম দিকে বিভাগীয় শহর হতে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে বদলি করা হয় ইমরানকে। এছাড়াও তিনি অসুস্থতার মিথ্যা অজুহাত দেখিয়ে আগস্ট ২০২২ থেকে কর্মস্থলে হাজির রয়েছেন। পরবর্তীতে ইমরান হরিদাসের মাধ্যমে নিজের বদলি বাতিল করার চেষ্টা করেন। ইমরান যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাধ্যম ছাড়া তার বদলি বাতিলের জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে আবেদন করেন। উক্ত আবেদনের একটি কপি তিনি তাওহীদকেও দেখান। তারপর তারা দু’জন মিলে ওই কপির ওপরে প্রধানমন্ত্রীর পরিবারের একজন সদস্যের নাম লিখে ভুয়া সীল লাগিয়ে একটি ডিও লেটার তৈরি করেন এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার মোবাইলে অ্যাপসের মাধ্যমে পাঠিয়ে বদলির আদেশ বাতিল করে পূর্বের পদে বহালের জন্য সুপারিশ করে। উক্ত ডিও লেটারটি সন্দেহজনক মনে হওয়ায় কর্তৃপক্ষ এনএসআইয়ের কাছে অভিযোগ করেন। উক্ত অভিযোগের ছায়াতদন্তে ঘটনার সত্যতা মেলে। আর ঘটনা তদন্তেই বেড়িয়ে আসে তাদের প্রতারণার নানা কৌশল।

 

আসামিদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন আছে বলেও জানান র‍্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ

কম খরচে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিন

কম খরচে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিন