গুজব যখন হাতিয়ার

প্রকাশিত: ১২:৪৬ অপরাহ্ণ, ডিসেম্বর ১৪, ২০২২

গুজব যখন হাতিয়ার

নাসরীন মুস্তাফা : এখন যার ইন্টারনেট সংযোগ আছে, সে চাইলেই সত্য-মিথ্যা যা কিছু গল্পকে সত্যের মতো করে ছড়িয়ে দিতে পারে। তথ্য পাওয়ার অধিকার সব নাগরিকের। অবশ্যই তা সঠিক ও সত্য তথ্য। মিথ্যে ও ভুয়া তথ্য ছড়ানো কখনোই নাগরিক অধিকার হতে পারে না।

 

এতে সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানসমূহের উপর নাগরিকের আস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে ফেলা হয়। মানুষ ভরসা করতে ভয় পায়। এতে ব্যক্তি পর্যায়ে সামাজিক ও মানসিক ক্ষতি যেমন বাড়ে, সমাজ ও রাষ্ট্র ক্ষতিগ্রস্ত হয় বৃহত্তর অর্থে।

 

বিভিন্ন দেশের নির্বাচন সামনে রেখে ফেসবুক, টিকটক ও টুইটারের মতো নানা রকমের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গুজব ছড়িয়ে দেওয়ার প্রমাণ মিলেছে মজিলা ফাউন্ডেশন পরিচালিত এক জরিপে। উদ্দেশ্যমূলক মিথ্যে ও ভুয়া তথ্য ব্যবহার করে এসব গুজব ছড়ানো হয়েছে। এ বছরের ৯ আগস্ট কেনিয়ায় অনুষ্ঠিত নির্বাচনের আগে, নির্বাচনের সময়ে ও পরে উদ্দেশ্যমূলকভাবে তথ্য লুকিয়ে, মিথ্যে ও ভুয়া তথ্য দিয়ে গুজব ছড়ানোর প্রচুর প্রমাণ উল্লেখ করে পরিস্থিতি কতটা ভয়াবহ হয়েছিল, আরও কত ভয়াবহ হতে পারত, তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে।

 

মে মাস থেকে শুরু হয়েছিল গুজব তৈরির সর্বাত্মক চেষ্টা। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভিডিও ছেড়ে, ভুয়া জরিপভিত্তিক ভুয়া নিউজ সাইট খুলে ব্যক্তিবিশেষ এবং গ্রুপ গুজব সৃষ্টি করেছে। এরপর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের এলগরিদম ভুয়া ও মিথ্যে তথ্যকে বহুগুণে ছড়িয়ে পড়তে সাহায্য করেছে।

 

৯ আগস্ট নির্বাচন অনুষ্ঠানের পর রাষ্ট্রপতি, জাতীয় ও কাউন্টি প্রতিনিধি নির্বাচনের জন্য কেনিয়ার নির্বাচন কমিশন ছয় দিন সময় নিয়েছিল ভোট গণনা, যাচাই বাছাই ও ভোটের ফলাফল ঘোষণার জন্য। প্রথমবারের মতো কমিশন সর্বসাধারণের প্রবেশযোগ্য অনলাইন পোর্টাল চালু করেছিল, যেখান থেকে জনগণ ভোট গণনা কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করতে পেরেছে।

 

এই সময়ে পাল্লা দিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ‘বুনো জানোয়ার’ হেরে যাওয়ার, ‘বীর যোদ্ধা’ জয়লাভ করার ভুয়া খবর ছড়িয়ে পড়ে ভোটারদের অস্থির করে তুলেছিল। এই মাত্র নাইরোবিতে সেনাবাহিনী নেমেছে জাতীয় মিথ্যে খবর প্রচার করে উত্তেজনা বাড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা ছিল। নির্বাচন কমিশন কোন একজন রাষ্ট্রপতি প্রার্থীকে জিতিয়ে দেওয়ার জন্য ভোটের ফলাফল কারচুপি করছে, এই অসত্য তথ্য ছড়িয়ে দিয়ে জনগণকে উত্তেজিত করার চেষ্টা হয়েছে।

 

কেনিয়ার নির্বাচনের সব পক্ষের প্রার্থীরা নিজের পছন্দ বা মতের সাথে মিললেই তথ্য ও খবর শেয়ার করছিলেন, যার বেশিরভাগই মিথ্যে তথ্য। এর অর্থ পছন্দ হলে যাচাই না করেই গুজব ছড়িয়ে দিতে সব পক্ষই সমানভাবে আগ্রহী। রাষ্ট্রপতি উহুরু কেনিয়াত্তা দুই দফায় দায়িত্ব পালন করেছেন বলে প্রার্থী হতে পারলেন না। উপরাষ্ট্রপতি উইলিয়াম রুটো প্রার্থী হলেন, বিপক্ষে ছিলেন রায়লা ওডিঙ্গা।

 

বিবিসি নিউজ স্টোরির ভাষ্যে এরকম একটি টিকটক ভিডিও এল বাজারে যে আমেরিকার সাবেক রাষ্ট্রপতি বারাক ওবামা জনাব রুটোর প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করেছেন। ভালো করে লক্ষ্য করলেই বোঝা যায়- বাক্য অশুদ্ধ, বারাক ওবামার মুখাবয়ব অস্বাভাবিক, বিবিসি স্টুডিও’র ব্যাকগ্রাউন্ডের ব্যানারের সাথে ভিডিওতে দেখানো ব্যানারের রং মিলছে না। পুরোপুরি গুজব ছিল এটি।

 

২০১৮ সালে ওয়াশিংটনে স্মিথসোনিয়ান ইনস্টিটিউটে বারাক ওবামা ভাষণ দিয়েছিলেন, সেই খবরের ভিডিওকে মনমতো ব্যবহার করেছে গুজবসৃষ্টিকারী ব্যক্তি অথবা গ্রুপ। আবার উইলিয়াম রুটোর বিরুদ্ধ পক্ষ পত্রিকার প্রথম পাতায় খবর এনে দিল যে, রুটোর এইচআইভি পরীক্ষার পয়সা দিচ্ছেন রাষ্ট্রপতি কেনিয়াত্তা। জনাব রুটো সত্যি সত্যি এইচআইভি পজিটিভ কি না, খবরে তার উত্তর না মিললেও গুজব কিন্তু তৈরি হয়ে গেল।

 

মজিলা ফাউন্ডেশনের সম্মানিত ফেলো ওডাঙ্গা মাদুং গবেষণা দলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তিনি চীনের ভিডিও প্ল্যাটফর্ম টিকটক-কে সবচেয়ে দ্রুতগতিতে রাজনৈতিক তথ্যের বিকৃত রূপকে ছড়িয়ে দেওয়ার মাধ্যম বলে উল্লেখ করেছেন। এই বিকৃতি এতটাই ভয়ংকর, জয়লাভ করলেও উইলিয়াম রুটো যাতে ক্ষমতা নিতে না পারেন সেজন্য সুপ্রিম কোর্টে পিটিশন দায়ের করা হয়েছে বলে ছবি দিয়ে খবর প্রচার করা হয়, যদিও এরকম কোন পিটিশন আদৌ করা হয়নি।

 

জনগণ কিন্তু পিটিশন করা হয়েছে, এই খবরেই মেতে উঠেছিল। কেনিয়াতে ঘটলেও মজিলা ফাউন্ডেশন মনে করছে, ঘটনাটি সব দেশের জন্যই চিন্তার বিষয়। রয়টার কেনিয়ার জনগণের উপর একটি জরিপ করে দেখেছে, শতকরা ৭৫ ভাগ কেনিয়ান অনলাইনে সত্য ও মিথ্যে খবরের মাঝে পার্থক্য ধরতে অক্ষম। বাংলাদেশের কত জন সত্য ও মিথ্যে তথ্যের পার্থক্য বুঝতে পারেন এবং বোঝাটা জরুরি বলে ভাবেন? গুজব বিষয়ে সচেতনতার অভাব কেনিয়াতে আছে, আমাদেরও যে আছে তা বুঝতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে চোখ রাখলেই বোঝা যায়।

 

যত দ্রুত যে কোন তথ্য ছড়িয়ে পড়ে, সেরকম দ্রুততার সাথে ফ্যাক্ট চেকিং করা হয় না বলে সময়ের দৌড়ে গুজব প্রক্রিয়া এগিয়ে যায়, লাভবান হয় গুজবসৃষ্টিকারী পক্ষ। গুজবের জন্য মিথ্যে ও ভুয়া খবর তৈরির পরিমাণও বেশি, সে তুলনায় সত্য খবর কম। কেনিয়ার নির্বাচনের আগের সপ্তাহে দশ মিলিয়ন ভুয়া পোস্ট, খবর, ভিডিও, বিজ্ঞাপন ছড়ানো হলেও সত্য খবর ছিল মাত্র কয়েক শ’! নির্বাচন বিশেষজ্ঞ, রাজনৈতিক বিশ্লেষক, সুশীল সমাজের প্রতিনিধিত্বকারী বিশিষ্ট ব্যক্তিদের বক্তব্যের খন্ডিত, কখনো বিকৃত, কখনো পুরো মিথ্যে বক্তব্যের স্ক্রিনশটকে কাজে লাগিয়ে গুজব তৈরি করার হিড়িক পড়েছিল।

 

তদন্তে জানা গেছে, এরকম বক্তব্য তারা আদৌ দেননি। কিন্তু সেই সত্য জানতে তো সময় লেগেছে। এর মধ্যে ভোটারদের প্রভাবিত করা সম্ভব হয়েছে, জনগণকে বিভ্রান্ত করা গেছে, অপেক্ষাকৃত তরুণ-অশিক্ষিত-বিভ্রান্ত অংশ পরিকল্পনা মাফিক উত্তেজিত হয়েছে। পুলিশের গুলিতে ১০০ জন মানুষ মারা গেছে বলে তথ্য ছড়িয়ে পড়লেও নির্বাচন কমিশনের হিসেবে এই সংখ্যা ২৪। গুজব ছড়িয়ে একটি মানুষেরও মৃত্যু হলে এর চেয়ে দুঃখজনক ঘটনা আর কী হতে পারে?

 

গুজবসৃষ্টিকারী পক্ষের চাওয়া কিন্তু সহিংসতা, মানুষের মাঝে বিভেদ তৈরি করে ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করা। দুঃখজনক হলেও সত্যি, বেতার-টেলিভিশন ও সংবাদপত্রও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের খবরকে প্রচার করে এর বিস্তৃতি আরও ছড়িয়ে দিতে ভূমিকা রাখছে।

 

আবার মূলধারার মিডিয়া জনগণের চাহিদার সাথে তাল মিলিয়ে সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে সঠিক তথ্য প্রচার করতে পারছে না বলে অস্থির হয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে তথ্য জানতে চাইছে সাধারণ মানুষ। মূলধারার মিডিয়া সব সময় সত্যি বলছে, এই ধারণাতেও ফাটল ধরেছে নানা কারণে। সাধারণ মানুষের তথ্য পাওয়ার অধিকার এখন সত্যিই বড়ো বিপদে আছে। কেনিয়ার কথা বাদ দিন।

 

২০১৬ সালে ইউরোপিয় ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে আসতে বৃটেনকে প্রভাবিত করেছিল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া নানা গুজব, যাতে লাভবান হয়েছিল রাজনৈতিক ও অর্থনেতিক সুযোগসন্ধানী পক্ষ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে ডোনাল্ড জে. ট্রাম্পকে জিতিয়ে দিতে একই রকম ঘটনা ঘটলেও এসব নিয়ে খোলাখুলি আলোচনায় বসেনি সব পক্ষ।

 

গুজব ছড়িয়ে একটি দেশের নির্বাচনের ফলাফল বদলে দেওয়া যায় কিংবা সুযোগসন্ধানীদের স্বার্থসিদ্ধি হয়, এমন তথ্য বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে বলে গুজবসৃষ্টিতে উৎসাহী পক্ষের দাপট দিনকে দিন বাড়ছে বিশ্বের সব দেশেই। বিশেষ করে যেসব দেশের জনগণ রাজনৈতিক শিক্ষায় সচেতন নয়, রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের স্বার্থে জনগণের মতামতকে পরিচালিত করতে চায়, স্বার্থসন্ধানী ব্যবসায়ী-পেশাজীবী-আমলাদের সুযোগ নেওয়ার ধান্দা থাকে, সেসব দেশে গুজবের চাষাবাদে ফলন হয় ভালো।

 

করোনা অতিমারিতে বিপর্যস্ত ব্যক্তি-সমাজ-রাষ্ট্রের মানসিক স্বাস্থ্য, অর্থনেতিক অবস্থা পরবর্তীতে যখন রাশিয়া-ইউক্রেনের মাধ্যমে ঘটিয়ে দেওয়া বিশ্ব মোড়লদের স্বার্থসিদ্ধির যুদ্ধে আরও বিপর্যস্ত হতে থাকল, তখন মিথ্যে ও ভুয়া তথ্যের উদ্দেশ্যমূলক ব্যবহারের আগ্রহ যেন আরও বেড়ে গেছে।

 

অস্বীকার করার উপায় নেই, গুজব সৃষ্টিতে এখন মোটা অংকের অর্থের লেনদেন চলছে যা জনগণের কোনো কাজে আসছে না। কেনিয়াতে গুজব সৃষ্টির কাজটি স্পেনভিত্তিক ডানপন্থি সংগঠন সিটিজেনগো নিয়ন্ত্রণ করেছে বলে অভিযোগ ওঠার পর এক দেশে অবস্থান করে আরেক দেশের পরিস্থিতিকে নিয়ন্ত্রণ করার অপচেষ্টা ডিজিটাল মাধ্যম সম্বন্ধে ভীতিই তৈরি করছে।

 

ডিজিটাল মাধ্যমের সুফল নয় বরং এর কুফল জনগণের বিপর্যস্ত মানসিক অবস্থাকে আরও সঙ্গিন করে তুলছে। সমস্যা কাটিয়ে ওঠার ইতিবাচক চিন্তাকে গ্রহণ না করার পরোক্ষ তাড়না তৈরি করছে এমনভাবে যেন সমস্যাকে ভয়াবহ আকারে সত্যি বলে গ্রহণ করতে পারাটাই আসল কাজ, সমাধানের জন্য কোন চেষ্টার দরকার নেই।

 

জনগণের মাঝে স্পষ্টতঃ বিভক্তি তৈরি হচ্ছে। হতাশাচর্চাকারী আরেকজন হতাশাবাদীকেই বন্ধু মনে করছে, এর অন্যথা হলে ভাষার ব্যবহার কদর্য পর্যায়ে নিতেও আপত্তি নেই। সুযোগ পেলে মাঠেও নেমে যায় এরকম বন্ধুর দল। ২০২১ সালের জানুয়ারি মাসে আমেরিকার কংগ্রেস ভবনে হামলা কিংবা কিছুদিন আগে শ্রীলংকার রাষ্ট্রপতি ভবনে হামলা করতে যারা ছুটে গিয়েছিল, তারা কি সমাধানের খোঁজে গিয়েছিল? জনগণকে ম্যাংগো পিপল বলার দিন কবে শেষ হবে? সাধারণ মানুষকে কেন পুতুলের মতো নাচাবে অদৃশ্য হাত?

 

সহিংস ঘটনা ঘটাতে জনগণকে উস্কে দিতে গুজবকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করার অবসান হোক্।