বদলে যাচ্ছে ঢাকার যোগাযোগ ব্যবস্থা

প্রকাশিত: ১২:৪২ অপরাহ্ণ, ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০২৪

বদলে যাচ্ছে ঢাকার যোগাযোগ ব্যবস্থা

ফরেদৌস কামাল : চারশত বছরের পুরনো আমাদের এ রাজধানী ঢাকা। একেবারেই অপরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠা এ নগরী। ঢাকা রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) আওতাধীন এলাকার আয়তন দেড় হাজার বর্গকিলোমিটার। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ জনশুমারির (২০২২) তথ্য অনুযায়ী, ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন এলাকায় বাস করেন প্রায় ১ কোটি ৩ লাখ মানুষ। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) হিসেবে, ঢাকা মহানগরে নিবন্ধিত যানবাহনের সংখ্যা প্রায় ২০ লাখ ৫২ হাজার।বিপুলসংখ্যক মানুষ, সড়কের অনুপাতে ব্যক্তিগত যানবাহন বেশি হওয়া এবং পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনার ঘাটতি ঢাকাকে যানজটের নগরে পরিণত করেছে।

 

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) প্রতিবেদন অনুযায়ী, রাজধানীর যানজটের কারণে বছরে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ১ লাখ ১ হাজার ৩৬ কোটি টাকা, যা দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ২ দশমিক ৯ শতাংশ। এতে প্রবৃদ্ধি কমছে ৩ শতাংশের বেশি। দারিদ্র্য মোচনের হারও কমছে আড়াই শতাংশের কাছাকাছি। যানজটের কারণে শারীরিক ও মানসিক ক্ষতির সেই হিসাব যোগ করলে লোকসানের পরিমাণ আরও বাড়বে। দৈনিক ৫০ লাখ কর্মঘণ্টা গ্রাস করছে যানজট। ১৯৯৭-৯৮ সালের দিকে ঢাকার রাস্তায় যানবাহনের গড় গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ২৫ কিলোমিটার। দুই হাজার পাঁচ সালে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় বুয়েটের অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইন্সটিটিউটের করা গবেষণায় দেখা গিয়েছিল সেসময় ঢাকা শহরে ঘণ্টায় গাড়ির গড় গতি ছিল প্রায় ২১ কিলোমিটার। একই ইন্সটিটিউট গত ৩রা এপ্রিল ঢাকার মূল সড়কগুলোতে গাড়ির গতির উপর এক গবেষণা চালিয়েছে। যাতে দেখা গেছে সেদিন ঢাকায় গাড়ির গড় গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় চার দশমিক আট কিলোমিটার। সব মিলিয়ে ঢাকায় যানবাহনের গতি কমছে। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ব্যুরো অব ইকোনমিক রিসার্চের গবেষণার ওপর ভিত্তি করে গত সেপ্টেম্বরে প্রভাবশালী সাময়িকী টাইম–এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্বের সবচেয়ে ধীরগতির শহরের তালিকায় এখন ঢাকা শীর্ষে।

 

ডিএমপির ট্রাফিক বিভাগের মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তারা ফার্মগেট ও বিজয় সরণির বাইরে ১৫টি এলাকাকে যানজটের হটস্পট (কেন্দ্র) হিসেবে গণ্য করেন। যার মধ্যে রয়েছে কুড়িল বিশ্বরোড, বাড্ডা, রামপুরা, মহাখালী বাস টার্মিনাল এলাকা, পল্টন, গুলিস্তান, সদরঘাট, শাহবাগ, বাংলামোটর, মালিবাগ, যাত্রাবাড়ী, সায়েদাবাদ, নিউমার্কেট, সায়েন্স ল্যাব ও মিরপুর-১০ গোলচত্বর। ঢাকার রাস্তায় পাঁচ ধরনের অব্যবস্থাপনা দেখা যায় (ক). ফুটপাতগুলোর প্রায় পুরোটা হকারদের দখলে থাকায় পথচারীরা রাস্তা দিয়ে হাঁটেন। (খ) ট্রাফিক সংকেত (সিগন্যাল) ছাড়ার পর রোড পার হয়ে রাস্তা আটকে যাত্রী তোলা শুরু করে বাসগুলো।ফলে পেছনের যানবাহন সামনে যেতে পারে না। (গ) গোলচত্বর দিয়ে একসময় রিকশা চলাচল নিষিদ্ধ ছিল, এখন রিকশা চলে। মোড়ে ভিড় করে যাত্রীর অপেক্ষা করে রিকশাচালকেরা।

 

ফলে সড়ক সরু হয়ে যায়। (ঘ) পদচারী সেতু থাকলেও মানুষ হাত তুলে যানবাহন থামিয়ে রোড পার হয়। (ঙ) রিকশা, মোটরসাইকেল, প্রাইভেটকার ও বাসচালকেরা সুযোগ পেলে সংকেত না মেনেই চলাচল শুরু করে। ফলে যানজট তৈরি হয় । গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) এক জরিপ প্রতিবেদন তুলে ধরে গত সেপ্টেম্বরে জানায়, ঢাকাবাসীকে সড়কে প্রতি ২ ঘণ্টায় ৪৬ মিনিট কাটাতে হয় যানজটে বসে।যানজটের কারণে নগরবাসীর সময় ও অর্থ নষ্ট হচ্ছে।

 

এ সব কিছুকে বিবেচনায় নিয়ে বর্তমান সরকার ২০০৯ সালেই গণপরিবহনকে ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ গ্রহন করে। এরই ধারাবাহিকতায় যানজটে নাকাল রাজধানীবাসীর জন্য স্বস্তির দুই উপহার হয়ে এসেছে মেট্রোরেল ও ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে। এই দুই অবকাঠামো কীভাবে ঢাকার চেহারা বদলে দিয়েছে, তা এখন সবার জানা । ঢাকায় পর্যায়ক্রমে দূর হচ্ছে যানজট।রাজধানী ঢাকাকে যানজটমুক্ত করতে নগরজুড়ে মেট্রোরেল নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী মোট ছয় ধাপে মেট্রোরেল নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয়। ২০৩০ সালের মধ্যে রাজধানীর ঢাকা ও এর আশপাশ মিলিয়ে ছয়টি রুটে চলবে মেট্রোরেল। উড়াল ও পাতাল রেলপথ মিলিয়ে ছয়টি ধাপে মেট্রোরেল নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে । এমআরটি লাইন ১ থেকে এমআরটি লাইন ৬ পর্যন্ত রাজধানী ঢাকা ও শহরতলীতে হবে এই মেট্রোরেলগুলো ।গত ৪ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মেট্রোরেলের উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে পূর্ণ দৈর্ঘ্যের মেট্রোর যাত্রা শুরু হয়। এতে করে রাজপথের বুক চিরে ছুটে চলা মেট্রোরেল বাণিজ্যিক এলাকা মতিঝিল ছুঁয়ে দেয়। এই মেট্রোতে করে উত্তরা থেকে ফার্মগেট হয়ে মতিঝিলে অল্প সময়ে যেতে পারছেন নগরবাসী। এতে করে পথ চলাচলকারীদের কর্মঘণ্টা বেঁচে গেছে।

 

নাই যানজট; নাই বাসে যত্রীদের হুড়োহুড়ি; এসির বাতাস গায়ে লাগিয়ে অল্প সময়েই উত্তরা থেকে মতিঝিল যাওয়া যাচ্ছে। এমন যাত্রা যদি নারায়ণগঞ্জ,গাজীপুর, নরসিংদী, মুন্সিগঞ্জ ও মানিকগঞ্জ জেলায় যায় তাহলে কেমন হবে? হ্যাঁ এমনই এক পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে ডিএমটিসিএল কর্তৃপক্ষ। আগামীতেও মেট্রোরেলের চাকাকে গোটা ঢাকা শহরে ঘুরানোসহ ঢাকা জেলার পার্শ্ববর্তী কিছু শহর ও উপশহরেও নিয়ে যেতে কাজ শুরু করেছে ডিএমটিসিএল। রাজধানীর সঙ্গে আশপাশের এলাকার যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ করতে আরও পাঁচটি মেট্রোরেল প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। ২০৩০ সালের মধ্যে প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নের টার্গেট নিয়ে কাজ শুরু হয়েছে। Dhaka metro rail new route এর ১৩০ কিলোমিটার। এমনকি বাদ যাবে না ৫২ বাজার ৫৩ গোলি খ্যাত পুরান ঢাকাও।উড়ালে-পাতালে আমুল বদলে যাওয়া বাংলাদেশ, যোগযোগ অবকাঠামোখাতে রীতিমত বিপ্লব এনেছে। প্রতিবছর ঢাকা শহরে ৬ লাখ ১২ হাজার মানুষ যুক্ত হয়; যার দৈনিক হিসেবে দাঁড়ায় ১ হাজার ৭০০ জনে। সেই হিসেবে দিনকে দিন বেড়েই চলছে তিলোত্ত্বমা এই শহরের জনসংখ্যা।

 

ঢাকার কাওলা বা বিমানবন্দর এলাকা থেকে শুরু করে সাড়ে ১১ কিলোমিটার পর ফার্মগেট পর্যন্ত রাজধানীর সিগনাল বিহীন উড়াল সড়কের একাংশ চালু হয়েছে গত সেপ্টেম্বর মাসে । ২০১১ সালের ১৯ জানুয়ারি প্রকল্পটির নির্মাণ প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার পর এই পথ টুকু চালু হতে সময় লেগেছে প্রায় ১৩ বছর। এই আংশিক অবস্থা টুকু যখন চালু হলো তখন থেকেই এর সুবিধা পেতে শুরু করলো ঢাকাবাসী। মূল রাস্তা সাড়ে ১১ কিলোমিটার হলেও এই অংশে ১৫ টি i¨vম্পের মাধ্যমে আরও ১১ কিলোমিটার পথ যুক্ত হয়েছে উড়াল এক্সপ্রেসওয়ের সাথে। ফলে ঢাকার ২২ কিলোমিটার এলাকার নিমিষেই পারাপার হয়ে আসছে রাজধানীবাসী। এক্সপ্রেসওয়ে কর্তৃপক্ষের তথ্য অনুযায়ী ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে চালু হওয়ায় পর থেকে গত ৩০ জানুয়ারি ২০২৪ পর্যন্ত ৪৬ লাখ ৯৪ হাজার ৩৩৩ টি যানবাহন এক্সপ্রেসওয়ে ব্যবহার করেছে।

 

এসব যানবাহন থেকে মোট টোল আদায় হয়েছে ৩৮ কোটি ৯২ লাখ টাকা। এদিকে মেট্রোরেল ও এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে ঘিরে ফার্মগেটের অবস্থা আরও ব্যস্ত জনবহুল ও যানবাহনবহুল হয়ে পড়েছে। এক্সপ্রেসওয়ের কাজ দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলছে। এ বছরের শেষ নাগাদ সম্পূর্ণ কাজ শেষ করে ঢাকা চিটাগং রোড়ের কুতুবখালী পর্যন্ত জনসাধারণের ব্যবহারের জন্য উন্মুক্ত করতে চায় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। চলতি ফেব্রুয়ারি মাসের মধ্যে কাওরানবাজারের র‌্যাম্পটি জনসাধারণের ব্যবহারের জন্য উন্মুক্ত করার লক্ষ্যে দিনরাত কাজ চলছে এ অংশে।

 

এ i¨vম্পটি তেজগাঁও এ বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন কর্পোরেশন এর সামনে নামবে।এটি চালু হলে বিমানবন্দর থেকে বাধাহীনভাবে যানবাহনগুলো ফার্মগেট হয়ে এফডিসির সামনে দিয়ে হাতিরঝিল, মগবাজার, মালিবাগ, সাতরাস্তা ব্যবহার করে ঢাকা শহরের বিভিন্ন প্রান্থে দ্রুত যেতে পারবে। রেললাইন ধরে গড়ে উঠা ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে কাওরানবাজার থেকে চলে গেছ মগবাজারের দিকে। এই যাওয়া পথে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে বিএফডিসির সামনে এবং মগবাজারে ফ্লাইওভারকে দুইবার অতিক্রম করে এগিয়ে গেছে। কাওরান বাজার ও বাংলা মোটর এলাকার মাঝামাঝি একদিকে হোটেল সোনারগাঁও অন্যদিকে আছে বিয়াম স্কুল এন্ড কলেজ। এ অংশে ঝিলের বেশ কিছু অংশ ভরাট করে চলছে এক্সপ্রেসওয়ের নির্মাণ কাজ। এ প্রকল্প যখন শুরু হয় তখন নকশায় হাতিরঝিলের পরিকল্পনা ছিলো না।

 

পরবর্তীতে এটি সংযোজন করা হয়।ফলে পুরান ঢাকাও যুক্ত হচ্ছে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের সাথে। হাতিরঝিল থেকে মেট্রোরেলের উপর দিয়ে পান্থকুঞ্জ ছোঁবে এক্সপ্রেসওয়ের একটি র‌্যাম্প,যা মোতালেব প্লাজার সামনে দিয়ে কাটাবন হয়ে চলে যাবে পলাশীর মোড়ে। এর মাধ্যমে নীলক্ষেত, আজিমপুর,লালবাগ,চকবাজারসহ পুরান ঢাকার জনগণ ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের সুবিধার আওতায় আসবে। মগবাজার থেকে রেললাইন ধরে সোজা চলে গেছে চিটাগং রোড়ের কুতুবখালী পর্যন্ত ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে।

 

 

এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের কাজ ৩০ জানুয়ারি পর্যন্ত ৭২ শতাংশ শেষ হয়েছে। চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে বাকি ২৮ শতাংশ কাজ শেষ করতে চায় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। কমলাপুর স্টেডিয়ামের পাশ দিয়ে ছুটে যাবে এই এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েটি। হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে চিটাগং রোডের কুতুব খালী পর্যন্ত এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের মোট দৈর্ঘ্য ১৯.৭৩ কিলোমিটার। ইতোমধ্যে সাড়ে ১১ কিলোমিটার প্রস্তুত হওয়ার পর বাকি আছে আর কম বেশি ৮ কিলোমিটার পথ। সব মিলে এ পথে ৩১ টি র‌্যাম্প আছে।

 

এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে মোট ৪৫ কিলোমিটার পথের সংযোগ ঘটাবে।রাজধানীর ৩১ পয়েন্ট যুক্ত হবে এই এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের সাথে। পুরো এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে চালু হলে রাজধানীর যানজট অনেকাংশে কমে যাবে এমনটাই মনে করছেন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। আর এতে করে রাজধানীবাসীর যাতায়াত যেমন সহজ হবে তেমনি সময় ও অর্থ সাশ্রয় হবে। যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ ও আধুনিকায়ন হলে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নেও এর উল্লেখযোগ্য প্রভাব পড়বে।