গাজায় ইসরাইলি আগ্রাসন: ফিলিস্তিনের প্রতি তুরস্কের অবস্থান

প্রকাশিত: ১১:৩৭ পূর্বাহ্ণ, অক্টোবর ১২, ২০২৩

গাজায় ইসরাইলি আগ্রাসন: ফিলিস্তিনের প্রতি তুরস্কের অবস্থান

একে পার্টির বৈঠকে বক্তব্য রাখার সময় ফিলিস্তিনের মানচিত্র (যার অনেকটাই দখল করে নিয়েছে ইসরাইল) দেখাচ্ছেন প্রেসিডেন্ট এরদোগান। ছবি: ডেইলি সাবাহ

 

আন্তর্জাতিক ডেস্ক : ‘একজন ব্যক্তি শুধু এক জায়গায় জন্ম নিতে পারে। তবে তিনি অন্যত্র কয়েকবার মারা যেতে পারেন: নির্বাসনে এবং কারাগারে এবং দখলদারিত্ব ও নিপীড়নের দ্বারা একটি দুঃস্বপ্নে রূপান্তরিত স্বদেশে।’

 

বিশিষ্ট ফিলিস্তিনি কবি ও লেখক মাহমুদ দারবিশ ২০০৪ সালে নেদারল্যান্ডসে একটি পুরস্কার গ্রহণ বক্তৃতায় এমন কথা বলেছিলেন।

 

আজ গাজায় ইসরাইলের আক্রমণের জটিলত পরিস্থিতি যখন আমরা প্রত্যক্ষ করছি তখন এই গভীর শব্দগুলো অনুরণিত হয়।

 

ফিলিস্তিনিদের মাতৃভূমি কয়েক দশক ধরে ইসরায়েলি দখলদারিত্ব ও নিপীড়নের যন্ত্রণা সহ্যের উপকরণে পরিণত হয়েছে। পশ্চিম তীর, গাজা, পূর্ব জেরুজালেম বা তার বাইরেই হোক না কেন- দখলদারিত্ব, সহিংসতা এবং মৃত্যুর নিরলস বাহিনী ফিলিস্তিনিরা তাদের দৈনন্দিন অস্তিত্বের বুননে নিজেদের বুনিয়ে নিয়েছে।

 

ফিলিস্তিনে যুগ যুগ ধরে যা ঘটছে তার মূল কারণ ইসরাইলের দখলদারিত্ব। অথচ সেটাকে গুরুত্ব না দিয়ে তাদের নানাভাবে সান্ত্বনা দেওয়া হচ্ছে। ইসরাইলি হামলার মুখে সাধারণ নাগরিকদের মিশর কিংবা অন্যত্র নিরাপদ আশ্রয়ে নেওয়ার জন্য করিডর খোলার কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু কেন, মূল সমস্যায় কেন যাওয়া হচ্ছে না?

 

লেবানন, সিরিয়া এবং ইরানের সম্ভাব্য পরিবর্তিত পরিস্থিতির প্রভাব কেবল আঞ্চলিক নয়, বৈশ্বিক ভূ-রাজনৈতিক মঞ্চেও একটি ভূমিকম্পের মতো পরিবর্তন সূচিত করেছে। তেহরান ও হামাসের মধ্যে সাম্প্রতিক সম্পর্ক জোরদার করা, ইসলামিক জিহাদ গোষ্ঠীর সাথে সংযুক্তি সম্ভাব্য পতনের মাত্রায় জটিলতার স্তর যুক্ত করেছে।

 

তুরস্কের অবস্থান
‘আমরা প্রকাশ্যে ইসরাইলি ভূখণ্ডে বেসামরিক নাগরিক হত্যার বিরোধিতা করি। একইভাবে আমরা কখনই গাজায় নিরপরাধ মানুষদের নির্বিচারে হত্যাকে মেনে নেব না,’ বুধবার পার্লামেন্টে জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টির (একে পার্টি) সদস্যদের উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে এমন কথাই বলেছেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোগান।

 

তুর্কি নেতা গাজার বেসামরিক নাগরিকদের উপর নির্বিচারে হামলাকে একটি ‘গণহত্যা’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন এবং সতর্ক করেছেন, ‘গাজায় এমন অসামঞ্জস্যপূর্ণ হামলা বিশ্ব সম্প্রদায়ের চোখে ইসরাইলকে একটি অপ্রত্যাশিত অবস্থানে ঠেলে দিতে পারে৷ বেসামরিক বসতিতে বোমাবর্ষণ করা, এই অঞ্চলে মানবিক সহায়তা নিয়ে আসা যানবাহনকে অবরুদ্ধ করা এবং এই সমস্ত কিছুকে একটি দক্ষতা হিসেবে উপস্থাপন করা শুধু একটি গোষ্ঠীর প্রতিফলন হতে পারে, কোনো রাষ্ট্রের নয়।’

 

ফিলিস্তিনের পক্ষে তার অটল সমর্থনের পাশাপাশি এরদোগান, ‘দ্য ওয়ার্ল্ড ইজ গ্রেটার দ্যান ফাইভ’ (জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের পাঁচ স্থায়ী সদস্য, যাদের হাতে গোটা দুনিয়ার ভাগ্য নির্ধারিত) এর ব্যানারে কাজ করছেন এবং তিনি ইসরাইলের সংঘটিত অন্যায়ের অটল সমালোচক হিসেবে দাঁড়িয়েছেন। একই সঙ্গে ইসরাইলসহ আঞ্চলিক রাষ্ট্রগুলোর সাথে তুরস্কের সম্পর্ক স্বাভাবিককরণের মাধ্যমে দেশটি একটি সম্ভাব্য মধ্যস্থতাকারী হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।

 

এরদোগান আরও বলেছেন, তুরস্ক হিসেবে আমরা বিবাদমান গ্রুপগুলোকে সংযম দেখানোর আহ্বান জানাই। আমরা চাই, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এই অঞ্চলে যুদ্ধ বন্ধ হোক এবং গ্রুপগুলোর মধ্যে সমস্যাগুলো আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করা হোক।’

 

এ ছাড়া এরদোগান এবং তার পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাকান ফিদান উভয়েই উত্তেজনা কমানোর জন্য ‘শাটল ডিপ্লোমেসি’ (নিরপেক্ষ অবস্থান থেকে বিবাদমান পক্ষগুলোর মধ্যে কূটনীতি করা) চালিয়ে যাচ্ছেন।

 

‘আমরা চাই না গাজা, ইসরাইল, সিরিয়া বা ইউক্রেনে শিশু, বেসামরিক মানুষ এবং নিরপরাধ মানুষ মারা যাক এবং আমরা আরও রক্তপাত চাই না,’ জোর দিয়ে বলেছেন এরদোগান।

 

সংযমের আহ্বান জানিয়ে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট আলোচনার মাধ্যমে যুদ্ধ বন্ধ করার আহ্বান জানিয়েছেন। আরও রক্তপাত বন্ধ করার প্রতিশ্রুতি একটি গঠনমূলক মধ্যস্থতাকারী হিসেবে তুরস্কের ভূমিকার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ, যা ইউক্রেনে একটি শস্য চুক্তির অর্জনের মাধ্যমে সংঘাতে অবিরাম প্রচেষ্টার আন্তরিকতা কার্যকরভাবে প্রমাণ করেছে।

 

যাইহোক, তুরস্ক ফিলিস্তিনের বিষয়ে তার অবস্থানকে স্পষ্টভাবে বর্ণনা করেছে। আঙ্কারার এই অবস্থান তার পশ্চিমা মিত্রদের থেকে প্রস্থান- যারা ইসরাইলকে তার অবৈধ দখল ও সহিংসতা সত্ত্বেও সমর্থন করে। তুরস্ক ফিলিস্তিনকে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠার পক্ষে কাজ করে, ১৯৬৭ সালের সীমানার উপর ভিত্তি করে যার রাজধানী হবে পূর্ব জেরুজালেম। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদসহ আন্তর্জাতিক ফোরামে ধারাবাহিকভাবে বিষয়টি উত্থাপন করা হয়।

 

বর্তমান অনিশ্চিত পরিস্থিতিতে বেসামরিক লোক হতাহতের সংখ্যা হ্রাস করা এবং আঞ্চলিক দেশগুলোতে সংঘাতের বিস্তার রোধ করা আঙ্কারার জন্য সর্বাধিক উদ্বেগের বিষয়। এরদোগান ও হাকান ফিদান উত্তেজনা প্রশমন ও মধ্যপ্রাচ্যে স্থিতিশীলতা বজায় রাখার ক্ষেত্রে তুরস্কের মুখ্য ভূমিকার উপর জোর দিয়ে শাটল কূটনীতিতে জড়িত।

 

প্রেসিডেন্ট এরদোগানের নেতৃত্বে তুর্কি কর্মকর্তাদের তীব্র প্রচেষ্টা ইসরাইল ও ফিলিস্তিনের মধ্যকার উত্তেজনাকে লেবানন ও ইরানে ছড়ানো প্রতিরোধ করার প্রতিশ্রুতি প্রতিফলিত করে যে, এই উচ্চতর অস্থিরতার সময়ে এটি একটি অপরিহার্য উদ্যোগ।

 

তুরস্কের ডেইলি সাবাহ পত্রিকায় প্রকাশিত মেহমেত সেলিকের কলামের সংক্ষেপিত অনুবাদ