দুবাই: রমজান, ইফতার ও ঐতিহ্য

প্রকাশিত: ৭:৩৪ অপরাহ্ণ, মার্চ ২০, ২০২৪

দুবাই: রমজান, ইফতার ও ঐতিহ্য

আন্তর্জাতিক ডেস্ক :  দেশে দেশে রমজান ও ইফতার আয়োজনে রয়েছে বাহারি ঐতিহ্য। তেমনি সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের প্রশ্নে ‘লা জাবাব’ আরব রীতি।

 

আরব্য রজনীর গল্প আর বিস্তর মরুভূমির মতোই সুবিশাল আরবিদের ঐতিহ্য ও খাদ্য তালিকা। বিশ্বব্যাপী দীর্ঘ এক মাস ধরে একই সময়ে একই নিয়মে মুসলমানরা রোজা/সিয়াম পালন করে আসছেন। তবে মাসব্যাপী রোজা পালনের এ ইবাদতের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে দেশ ও অঞ্চলভেদে কিছু সামাজিক রীতি ও আইনি বাধ্যবাধকতা, যা মূল ইবাদতের কোনও রদবদল ঘটায়নি। রূপালী বাংলাদেশের পাঠকদের জন্য আজকের বিশেষ প্রতিবেদনে মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাতের স্থানীয়দের রমজান, ইফতার ও ধর্মীয় আচার সম্পর্কে বিস্তারিত জাননোর চেষ্টা করবো।

 

আরবিদের ইফতার: আরবিরা যে সমস্ত ইফতার তাদের খাবারের তালিকায় রাখেন তার অধিকাংশই নিজেদের ঘরে তৈরি হয়ে থাকে। ইফতারের মেন্যুতে খেজুর অত্যবশ্যকীয়। তার সঙ্গে ফলমূল ও দুগ্ধজাত শরবত পানীয় হিসেবে গ্রহণ করেন। এরপর ছোলা, বাদাম, রসুনসহ বেশ কিছু উপাদানের সংমিশ্রণে তৈরি পেস্ট জাতীয় খাবার হামুস দিয়ে খবুজ বা রুটি খান। ভারী খাবারের তালিকায় চিকেন বিরিয়ানি, মাটন বিরিয়ানি বা বীফ বিরিয়ানি তাদের নিত্যদিনের খাবার। আপেল, আঙুর, কমলা, কলা, পেয়ারা, তরমুজ, ডালিম, শসা, গাজর থেকে শুরু করে নানা পদের ফল দিয়ে তৈরি করা হয় বিশেষ ধরণের সালাদ। শুধু ফলও থাকে ইফতারের থালায়। তবে তেলে ভাজা খাবারের প্রতি তাদের তেমন কোন আকর্ষণ নেই। এক্ষেত্রে গরু, ছাগল, ভেঁড়া কিম্বা মুরগির মাংসের নানা পদের কাবাব পছন্দ করেন তারা। সুরবা (স্যুপ) আরবদের মূল খাবারের অংশ। শরীরে চাঙ্গা ও ফুরফুরে ভাব ফিরিয়ে আনতে এশা ও তারাবির আগে লাল চা ও গাহওয়া পরিবেশন করা হয়। বিশেষ করে ঘরে মেহমান থাকলে তাদের মাঝে ঘরের একজন সদস্য রুটির পাত্র নিয়ে হাজির হন। যেমন মুখরোচক তেমনি স্বাস্থ্যকর হওয়া চাই তাদের খাবার। কারণ স্বাদের সঙ্গে সুস্বাস্থ্যকেও প্রাধান্য দেন তারা।

 

ইফতারের নিয়ম: সংযুক্ত আরব আমিরাত না শুধু, বলা চলে সমগ্র আরবদের সাধারণ অভ্যাস হলো আজানের সঙ্গে সঙ্গে তারা শুকনো ও পাকা খেজুর এবং পানি দিয়ে ইফতার সেরে নেওয়া। তারপর মুআজ্জিন নামাজের ইকামত দিলে খাবার ছেড়ে সবাই জামাতের জন্য ছুটে যায়। মাগরিবের নামাজ আদায়ের পর সবাই মিলে ইফতারের মূলপর্ব শুরু হয়। তারপর ইফতারপর্ব শেষ করে সবাই এশা ও তারাবির জন্য মসজিদমুখী হন। রমজানে ভালো কাজের প্রতিযোগিতা করেন।
ইফতার ক্যানন: দেশটির সূচণালগ্ন থেকে রমজানে ইফতার ক্যানন এক দারুণ জমকালো ঐতিহ্য। দেশটির বিভিন্ন শহর, গুরুত্বপূর্ণ স্থান, শপিংমলের সামনে স্থাপন করা হয় এই ইফতার ক্যানন। ইফতারের নির্ধারিত সময়ে স্বমহিমায় গর্জে ওঠে ক্যাননগুলো। এগুলো পরিচালনা করেন দুবাই পুলিশের চৌকস সদস্যরা।

 

রমজানে কর্মব্যস্ততা: সেহরি কিম্বা ইফতার। এই সময়টা আরবিরা নিজ পরিবারের সঙ্গে থাকতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। তাই শত কর্মব্যস্ততা ফেলে ইফতারের আগ মুহূর্তে ঘরে ফেরেন তারা। এ কারণে রমজান এলেই আরব আমিরাতে সরকারি-বেসরকারি অফিসের সময়সূচিতে পরিবর্তন আনা হয়। দেশটির ফেডারেল অথরিটি ফর গভর্নমেন্ট হিউম্যান রিসোর্সেসের জারি করা প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, রমজান মাসে সোমবার থেকে বৃহস্পতিবার সকাল ৯টা থেকে দুপুর আড়াইটা পর্যন্ত কাজ করবেন সরকারি কর্মীরা। শুক্রবার তাদের কাজের সময় নির্ধারণ করা হয়েছে সকাল ৯টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত। এর ফলে সরকারি কর্মীরা সোমবার থেকে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত সাড়ে তিন ঘণ্টা এবং শুক্রবারে দেড় ঘণ্টা কম কাজ করবে। তবে কিছু ব্যতিক্রমী ক্ষেত্রে এর চেয়ে বেশি কর্মঘণ্টারও সুযোগ রাখা হয়েছে। প্রজ্ঞাপনে যারা চাকরিস্থল থেকে অনেক দূরে বাস করেন, শুক্রবারে তাদের জন্য বাড়িতে থেকে কাজ করারও সুযোগ রাখা হয়েছে। এসব পরিকল্পনা পবিত্র রমজান মাসে কর্মীদের ইবাদত-বন্দেগি পালনে সহায়তা করবে বলে আশা করা হচ্ছে।

 

নামাজ: রমজানে রোজা, দান কিম্বা নামাজেও চলে প্রতিযোগিতা। এসময়টাতে মসজিদমুখী হতে দেখা যায় অধিকাংশ আরবীদের। বেশির ভাগ আরবীরা নিজেদের গাড়ি নিয়ে স্বপরিবারে মসজিদে যান। কারণ আরব আমিরাতের প্রায় সকল মসজিদেই নারী ও পুরুষের পৃথক নামাজের ব্যবস্থা রয়েছে। বাচ্চাদের জন্য রয়েছে আলাদা সংরক্ষিত এলাকা বা কিডস জোন। রমজানে আরব আমিরাতে বেশির ভাগ মসজিদে ৮ রাকাত তারাবিহ নামাজ আদায় করা হয়। তবে নামাজের শেষ রাকাতে বিশেষ দোয়া করা হয়। এছাড়া প্রতি ওয়াক্তের নামাজ শেষে রমজানের গুরুত্ব, তাৎপর্য  ও করণীয় শীর্ষক আলোচনা করেন ইমাম সাহেব।

 

বিনামূল্যে ইফতার বিতরণ: আরব আমিরাতের সরকারি বিভিন্ন সংস্থা, অলাভজনক দাতব্য সংস্থা,সংগঠন, ব্যবসায়ী ও ব্যক্তি উদ্যোগে বিভিন্ন জায়গায় বিনামূল্যে ইফতার বিতরণ করা হয়। ইফতারে থাকে পানি, জুস, দুধ, ফল, খেজুর আর কখনও বা বিরিয়ানির মতো কোনো খাবার। এ ধরনের ইফতার আয়োজন করা হয় আবাসিক এলাকার সন্নিকটে বা কোনো মসজিদের পাশে তাঁবু টানিয়ে। কিম্বা মসজিদ প্রাঙ্গনেই। দীর্ঘদিন যাবত এমন ইফতার আয়োজন করে আসছে আরব আমিরাতের অন্যতম পুরনো দাতব্য সংস্থা দার আল বার। প্রতি বছর সারা দেশে অর্ধশতাধিক তাঁবু স্থাপন করে তারা। ১৯৯৯ সাল থেকে এমন আয়োজন করে আসছে সংস্থাটি। সেই ধারাবাহিকতায় প্রতি বছর ইফতার সংগ্রহ ও বিতরণের হার বেড়ে চলছে। গেলো বছর (২০২৩ সাল) এ যাবৎকালের সবচেয়ে বড় আয়োজন করে সংস্থাটি। সেবার দুবাই শাসক শেখ মোহাম্মদ বিন রাশিদ আল মাখতুমের সোশ্যাল ইনিশিয়েটিভস কর্মসূচির আওতায় ‘ওয়ান বিলিয়ন মিলস’ ইফতার প্রোজেক্ট বাস্তবায়ন করা হয়। যে কেউ এখানে ইফতারে শরিক হতে পারেন। চাই সে রোজাদার হোক বা না হোক, মুসলিম হোক বা না হোক। এটাই হচ্ছে রমজান মাসের মাহাত্ম্য।

 

দান-সদকা: আরব আমিরাতের সকল মসজিদ, শপিংমল, সুপারমার্কেট ও হোটেল-রেস্তোরায় দান বক্স স্থাপন করা থাকে। সারা বছরই কম বেশি দান সদকা করে থাকেন আরবীরা। তবে রমজান এলে এই দানের পরিমাণ আরও কয়েকগুণ বাড়িয়ে দেন তারা। যেমন- নামাজ শেষে, পথ চলতে নিম্ন আয়ের, অস্বচ্ছল মানুষ দেখলে তারা এক হাতে পকেট থেকে কিছু টাকা বের করে তার হাতে দিয়ে দেন। কখনও বা ইফতার ও খাদ্য সামগ্রী নিয়ে ঘুরে ঘুরে অস্বচ্ছল ও ভবঘুরে মানুষের মধ্যে বিতরণ করেন। তবে ছবি তোলা, প্রচার করা, লোক দেখানো দান এড়িয়ে চলেন আমিরাতিরা। তবে ধর্মীয় অনুভূতিকে পূঁজি করে ভিক্ষাবৃত্তিকে নিরুৎসাহিত করা হয় দেশটিতে। কেউ ভিক্ষা করলে তাকে আটক করে জেল জরিমানাসহ দেশ থেকে আজীবনের জন্য (ব্লাক লিস্ট/আউটপাশ) বের করে দেয়ার কঠিন বিধান রয়েছে।

 

সুলভ পণ্যমূল্য: রমজানে আরব বিশ্বে ব্যবসায়ীদের মধ্যে এক প্রকার উৎসবের আমেজ লক্ষ্য করা যায়। দেখা যায় মূল্যছাড়ের প্রতিযোগিতা। এশিয়ার অন্যান্য দেশে যেখানে  রমজান মাস এলেই দেখা যায় নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের আকাশচুম্বি মূল্যবৃদ্ধি, কৃত্রিম সংকট, ভোক্তা হয়রানি থেকে শুরু করে আরও কত কিছু। বীপরিতে আরব বিশ্বে রমাজান এলে দেখা যায় ভিন্ন দৃশ্য। কে কত কম দামে পণ্য বিক্রি করতে পারে এটিই যেন তাদের প্রতিযোগিতা! ৫০ থেকে ৭৫ শতাংশ পর্যন্ত ছাড় দেওয়ার ঘোষণা দেন তারা। দাম কমানো বেশির ভাগ জিনিসই অত্যাবশ্যকীয় খাদ্যপণ্য হয়ে থাকে।

কম খরচে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিন

কম খরচে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিন