প্রকাশিত: ১১:২১ পূর্বাহ্ণ, মার্চ ৮, ২০২৩
নিউজ ডেস্ক : সিলেটে ক্লু-লেস হত্যাকাণ্ডের দুই সপ্তাহ পর রহস্য উদঘাটন করেছে পুলিশ। এতে ছোট ভাইয়ের হাতে বড় ভাই খুনের চাঞ্চল্যকর ঘটনা সামনে এসেছে।
রহস্য উদঘাটনের পর বুধবার (৮ মার্চ) দুপুরে সংবাদ সম্মেলন করেছে সিলেট মহানগর পুলিশ (এসএমপি)। দুপুরে এসএমপি সদর দপ্তরে এ সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।
গত ২০ ফেব্রুয়ারি সকালে সিলেটের দক্ষিণ সুরমার বরইকান্দির টেকনিক্যাল রোডের মেসার্স ইমরান চায়না অটো রাইসমিলের সামনে সুরমা নদীর পাড় থেকে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় সাজ্জাদ আলী নামের (৩৫) এক যুবকের বস্তাবন্দী লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। মরদেহে আঘাতের চিহ্ন ছিলো। কয়েকদিন পর লাশের পরিচয় শনাক্ত হয়। সাজ্জাত সিলেটের জালালাবাদ থানার বসন্তরাগাঁওয়ের মৃত সোয়াব আলীর ছেলে।
বুধবার এসএমপি’র সংবাদ সম্মেলনে অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম এন্ড অপস্) মু. মাসুদ রানা ও উপ-কমিশনার (দক্ষিণ) সুহেল রেজা পিপিএম বিস্তারিতভাবে বিষয়টি জানাতে গিয়ে বলেন- প্রবাস ফেরত সাজ্জাদ আলীকে পারিবারিক দ্বন্ধের জের ধরে তার আপন ছোট ভাই মো. জাহাঙ্গীর আলী (২৭) হত্যা করেছেন। পরে বড় ভাই মো. সিরাজ আলীর (৪২) সহায়তায় হাত-পা বেঁধে লাশ বস্তবন্দী করে বরইকান্দিতে সুরমা নদীর পাড়ে ফেলে আসেন।
ঘটনা যেদিন :
পুলিশ বলছে- হত্যার ঘটনাটি ১৮ ফেব্রুয়ারি ঘটেছে। ১৮ ফেব্রুয়ারি হত্যার পর লাশ গুমের পরিকল্পনা করতে জাহাঙ্গীরদের একদিন চলে যায় এবং ১৯ ফেব্রুয়ারি রাতে সুরমার পাড়ে লাশ এনে ফেলে দেওয়া হয়। পরদিন (২০ ফেব্রুয়ারি) স্থানীয়দের খবরের ভিত্তিতে পুলিশ গিয়ে লাশটি উদ্ধার করে। অথবা ১৮ ফেব্রুয়ারি হত্যার পর ওইদিন রাতেই লাশ নদীর পাড়ে ফেলে যায় তারা। একদিন পর (২০ ফেব্রুয়ারি) স্থানীয়রা লাশটি দেখতে পেয়ে পুলিশকে খবর দেন। তবে এ বিষয়ে আরও তদন্ত করছে পুলিশ।
যে কারণে সাজ্জাদের উপর ভাইয়েদের ক্ষোভ :
সাজ্জাদ কিছুদিন আগে দুবাই থেকে ফেরেন। পরিবারের পক্ষ থেকে গত বছর সাজ্জাদকে বিদেশ পাঠানো হলেও বিভিন্ন বাজে অভ্যাসের কারণে ৫ মাসের মাথায় তিনি দেশে ফিরে আসেন। দেশে এসে তিনি বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে আড্ডা দেওয়াসহ রোজগারবিহীন অবস্থায় দিন কাটাতে থাকেন। ছিলো তার অনেক বাজে অভ্যাসও। এজন্য তার টাকার প্রয়োজন পড়ে এবং পৈত্রিক সূত্রে পাওয়া তার অংশের ভিটা ও জমি তিনি বিক্রি করে দিতে চান। এতে বাধ সাধেন তার দুই ভাই। বিষয়টি নিয়ে বেশ কিছুদিন ধরে তাদের মাঝে দ্বন্দ্ব চলে আসছে। এ নিয়ে ১৮ ফেব্রুয়ারি গ্রাম্য মুরুব্বিদের নিয়ে বৈঠকে বসতে চাচ্ছিলেন সাজ্জাদ। কিন্তু এতে ভাইদের কোনো সম্মতি ছিলো না।
যেভাবে ঘটনা :
পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে ও আদালতে জবানবন্দীকালে জাহাঙ্গীর আলী জানান- পৈত্রিক জায়গা-সম্পত্তি নিয়ে ১৮ ফেব্রুয়ারি বিচার-সালিশ করাতে চেয়েছিলেন সাজ্জাদ। তাই সেদিন সন্ধ্যার পর তার বাড়িতে আসার জন্য গ্রাম্য মুরুব্বিদের দাওয়াতও দেন তিনি। এদিকে, ওই দিন বিকেলে সাজ্জাদ তার কক্ষে দা দিয়ে কুমড়া কাটছিলেন। এসময় বিচার-সালিশ নিয়ে তার সঙ্গে কথা বলতে যান ছোট ভাই জাহাঙ্গীর। একপর্যায়ে তাদের মাঝে বাকবিতন্ডা শুরু হয় এবং জাহাঙ্গীরকে মারধর শুরু করেন সাজ্জাদ। এসময় জাহাঙ্গীরও সাজ্জাদকে মারতে থাকেন এবং ধস্তাধস্তির এক পর্যায়ে দুজন কুমড়া কাটার দায়ের উপর পড়ে যান। এসময় সাজ্জাদের মাথার বাম দিকে গভীরভাবে কেটে যায়। প্রচুর রক্তক্ষরণে একপর্যায়ে মারা যান সাজ্জাদ।
সন্ধ্যার পর বড় ভাই সিরাজ ঘরে ফিরে ঘটনাটি জানতে পেরেও সাজ্জাদকে হাসপাতালে নেওয়া কিংবা পুলিশে খবর দেওয়ার উদ্যোগ নেননি তিনি। বরং সাজ্জাদের মৃত্যুর পর লাশ গুমের বিষয়ে ছোট ভাই জাহাঙ্গীরকে সহায়তা করেন সিরাজ।
যেভাবে লাশ লুকানোর পরিকল্পনা ও লুকানো :
ঘটনার পর পুলিশকে না জানিয়ে সাজ্জাদের লাশ লুকিয়ে ফেলার পরিকল্পনা করেন জাহাঙ্গীর ও সিরাজ। তারা ১৮ অথবা ১৯ ফেব্রুয়ারি রাতের বেলা ঘরের ছাদে থাকা কাপড় শুকানোর রশি কেটে নিয়ে এসে সাজ্জাদের হাত-পা বাঁধেন এবং লাশটি পলিথিনে পেঁচিয়ে পাটের বস্তায় ভরেন। পরে রাত ১২টার দিকে জাহাঙ্গীর কামালবাজার স্ট্যান্ডের পরিচিত একটি সিএনজিচালিত অটোরিকশা ডেকে নিয়ে আসেন। কিন্তু বস্তাটি গাড়িতে তুলতে তিনি কৌশল অবলম্ব করেন। একটি সিগারেট অটোচালকের হাতে দিয়ে তিনি বলেন- ‘ওটা তোমার জন্য, একটু দূরে গিয়ে খাও তুমি। কারণ আমি সিগারেটের ধোঁয়া সহ্য করতে পারি না।’ অটোচালক যখন একটু আড়ালে গিয়ে সিগারেট খাচ্ছিলেন তখন লাশের বস্তাটি তিনি অটোরিকশায় তুলে নেন। চালক ফিরলে জাহাঙ্গীর তাকে দক্ষিণ সুরমার বাবনায় যাওয়ার জন্য বলেন।
তবে দক্ষিণ সুরমায় এসে বাবনা যাওয়ার আগেই বরইকান্দির টেকনিক্যাল রোডের মেসার্স ইমরান চায়না অটো রাইসমিলের সামনে আসামাত্র অটোরিকশাটি থামাতে বলেন জাহাঙ্গীর। এসময় তিনি চালককে বলেন- ‘তুমি একটু দূরে গিয়ে দাঁড়াও, কারণ আমি এখানে প্রশ্রাব করবো। আর কারো সামনে আমি প্রশ্রাব করতে পারি না।’ জাহাঙ্গীরের পীড়াপীড়িতে অটোচালক একটু আড়ালে গিয়ে দাঁড়াতেই লাশের বস্তাটি নদীর পাড়ে ফেলে দেন তিনি। পরে অটোচালককে দক্ষিণ সুরমার বাবনায় নিয়ে গিয়ে ভাড়া দিয়ে বিদায় করে দেন জাহাঙ্গীর। পরদিন (২০ ফেব্রুয়ারি) সকালে স্থানীয়দের খবরের ভিত্তিতে দক্ষিণ সুরমা থানাপুলিশ ওই স্থান থেকে অজ্ঞাত হিসেবে সাজ্জাদের বস্তাবন্দী লাশ উদ্ধার করে।
ঘটনার পর জাহাঙ্গীরের নাটকীয় আচরণ :
লাশ উদ্ধারের একদিন পর লাশের পরিচয় শনাক্তের উদ্দেশে সংবাদমাধ্যমে বিজ্ঞপ্তি দেয় মহানগর পুলিশ। সেই বিজ্ঞপ্তি সিলেটের প্রিন্ট ও অনলাইন মিডিয়ায় প্রকাশিত হয়। ‘সিলেট প্লাস’ নাম একটি ফেসবুক পেইজেও প্রকাশিত হয় বিজ্ঞপ্তিটি। প্রায় এক সপ্তাহ পর জাহাঙ্গীর দক্ষিণ সুরমা থানায় উপস্থিত হয়ে তার ভাই সাজ্জাদ ‘নিখোঁজ’ রয়েছেন উল্লেখ করে ‘সিলেট প্লাস’-এ প্রকাশিত বিজ্ঞপ্তি দেখিয়ে হাসপাতালে থাকা লাশটি তিনি দেখতে চান। পরে পুলিশ তাকে নিয়ে ওসমানী হাসপাতালে যায় এবং মর্গে থাকা সাজ্জাদের লাশটি দেখেই তিনি এটি তার ভাইয়ের লাশ বলে শনাক্ত করেন।
এদিকে, ঘটনার পর খুনি শনাক্তে জোর তৎরতা চালায় পুলিশ। সুষ্ঠু ও গতিশীল তদন্তের স্বার্থে এসএমপি’র ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা দক্ষিণ সুরমা থানার সহকারী কমিশনার (এসি), ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ও তদন্ত কর্মকর্তাকে (এস.আই) একটি কমিটি গঠন করে দেন। তদন্তের একপর্যায়ে সাজ্জাদের ঘনিষ্ট বন্ধু লক্ষীপুর সদর থানার রাজাপুর গ্রামের মৃত ছিদ্দেক আলীর ছেলে সাহাজানকে (৩৯) গ্রেফতার করে রিমান্ডে নেয় পুলিশ। সাহাজানের সঙ্গে সাজ্জাদের লেন-দেনও ছিলো। কিন্তু তার কাছ থেকে কোনো সঠিত তথ্য উদঘাটন করতে পারেনি পুলিশ। পরে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক সূত্র পুলিশকে জানায়, সন্দেহের তালিকায় সাজ্জাদের ভাইদেরও যেন রাখা হয়।
এ তথ্য পাওয়ার পর পুলিশের তদন্তের মোড় ঘুরে যায় এবং জাহাঙ্গীরকে নজরদারিতে রাখতে শুরু করে পুলিশ।
অবশেষে রহস্য উদঘাটন এবং সাজ্জাদের দুই ভাই গ্রেফতার :
তদন্তের এক পর্যায়ে পুলিশ নিহত সাজ্জাদ আলীর বসতকক্ষে তল্লাশি চালিয়ে তার ব্যবহৃত কোনো কাপড় পায়নি পুলিশ। এতে সাজ্জাদের ভাইদের প্রতি পুলিশের সন্দেহ আরও বাড়ে। পরবর্তীতে বাসার ছাদের উপর কাপড় শুকানোর রশির দুটি কাটা অংশ সংগ্রহ করে পুলিশ। পুলিশ দেখতে পায়- সেই রশিরই মাঝখানের বড় অংশ দিয়ে সাজ্জাদের হাত-পা বাঁধা হয়। এটি একই রশি। তারপরেই পুলিশ জাহাঙ্গীর ও সিরাজকে গ্রেফতার করে এবং ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ চালায়। একপর্যায়ে জাহাঙ্গীর পুলিশের কাছে সব স্বীকার করে নেন এবং মঙ্গলবার আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দী দেন। সিলেট মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের বিজ্ঞ বিচারক সাইফুর রহমানের কাছে এ স্বীকারোক্তি দেন জাহাঙ্গীর। এর আগে তার দেওয়া তথ্যমতে হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত দা জালালাবাদ থানার বস্তন্তরগাঁও এলাকার একটি কবরস্থান থেকে উদ্ধার করে পুলিশ।
এবার মামলার বাদী কে?
চাঞ্চল্যকর এ ঘটনায় জাহাঙ্গীর বাদী হয়েই হত্যা মামলা দায়ের করেন। কিন্তু এবার মূল অভিযুক্ত হিসেবে চিহ্নিত হওয়ায় তিনি এবার বাদী থাকতে পারবেন কি না সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে এসএমপি’র উপ-কমিশনার (দক্ষিণ) সুহেল রেজা পিপিএম বলেন- এ ক্ষেত্রে দুটি নিয়ম আছে। প্রথমত জাহাঙ্গীরকে বিবাদী করা হবে এবং বাদী হবে পুলিশ। দ্বিতীয়ত নতুন নিয়ম অনুযায়ী- বাদীর ঘরেও জাহাঙ্গীরের নাম এবং বিবাদীর ঘরেও তার নাম থাকবে, আর সাক্ষীর ঘর থেকে তার নাম কেটে দেওয়া হবে। তবে এ বিষয়ে বিজ্ঞ আদালতের নির্দেশনাই চূড়ান্ত গণ্য করা হবে।
প্রথম গ্রেফতারকৃত সাহাজাহানকে কী করবে পুলিশ?
সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে সুহেল রেজা জানান- আরও তদন্ত শেষে পুরোপুরি নিশ্চিত হয়ে সাহাজাহানকে এ মামলা থেকে বাদ দেওয়া হবে।
এসএমপি’র সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (মিডিয়া) সুদীপ দাস, দক্ষিণ সুরমা থানার সহকারী কমিশনার (এসি) মো. মইনুদ্দিন খান, ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. কামরুল হাসান তালুকদার ও এ হত্যা মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা এস.আই মোহাম্মদ জালাল উদ্দিন।
উপদেষ্টা সম্পাদক : মো. রেজাউল ওয়াদুদ চেয়ারম্যান বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন পরিষদ (বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস এনফোর্সমেন্ট কাউন্সিল)
সম্পাদক ও প্রকাশক মো: আবু বক্কর তালুকদার
ব্যবস্থাপনা সম্পাদক : নূরুদ্দীন রাসেল
অফিস : ৩৭০/৩,কলেজ রোড,আমতলা, আশকোনা,ঢাকা-১২৩০,
Call : 01911120520
Email : info.sylhet24express@gmail.com
Design and developed by Web Nest