সিলেট সাবরেজিস্ট্রি অফিসে মানুষ বিক্রির দলিল!

প্রকাশিত: ৭:২৭ পূর্বাহ্ণ, ডিসেম্বর ৩, ২০২২

সিলেট সাবরেজিস্ট্রি অফিসে মানুষ বিক্রির দলিল!

নিউজ ডেস্ক : আঠারো শতকের প্রথম দিকে মানুষ বেচা-কেনা হতো সিলেটে। এমন ঘটনার চারটি দলিল ছিলো সিলেট সদর সাবরেজিস্ট্রি অফিসের মহাফেজখানায়। এসব দলিলে যেন আজও জীবন্ত হয়ে ফুটে রয়েছে তৎক্ষালীন মানুষ বেচাকেনার চিত্র। রয়েছে ঋণ শোধের জন্য এক মা ও তাঁর সন্তানের বিক্রির ইতিহাস। খবর ‘প্রথম আলো’র।

 

জানা যায়, ওই সময় দাস-দাসীর দাম ছিলো ১০ থেকে ২৫ টাকা। এসব দাস-দাসী ক্রয় করতেন তৎক্ষালীণ একই জেলার বিভিন্ন স্থানের বাসিন্দারা। দাস হিসেবে সবচেয়ে কম মূল্য ছিল শিশুদের। ৫০ বছরের জন্য মাত্র সোয়া ১ রুপিতে ৪ বছরের এক শিশু বিক্রির ঘটনাও ঘটেছিলো সেই সময়ের শ্রীহট্ট নামক বর্তমান সিলেটে।

 

চলতি বছরের সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে জাতীয় আর্কাইভস ও গ্রন্থাগার কর্তৃপক্ষ ১৮০১ সালের মানুষ বেচাকেনার দলিলের (নব দাসী ও অমরা দাসী বিক্রির নথি) একটি নকল কপি সিলেট সাবরেজিস্ট্রি অফিস থেকে সংগ্রহ করে। সেই দলিলের সূত্র ধরে বেরিয়ে আসে সিলেটে ২০০ বছর আগে মানুষ বেচাকেনার আরও ৩টি দলিল।

 

এ অফিসে পাওয়া সোয়া দুই বছর আগের চারটি দলিলই লেখা হয়েছে কয়েকটি ভাষা মিলিয়ে। মানুষ বিক্রির দলিলগুলোকে সেসময় বলা হতো কবলাপত্র। এগুলো উদ্ধারের পর নিয়ে যাওয়া হয় আইনজীবী ও শ্রীহট্ট সংস্কৃত কলেজের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ দিলীপ কুমার দাশ চৌধুরীর কাছে। প্রাথমিকভাবে সব ক’টিরই পাঠোদ্ধার করে তিনি বলেন, ‘এসব দলিলে অসমিয়া, সংস্কৃত ভাষার সঙ্গে ব্যবহৃত হয়েছে নাগরী লিপিও। মানুষ বেচাকেনার এই দলিলগুলো লেখার সময় তিনজন করে সাক্ষী রাখা হয়েছে। নিয়ম ছিলো- বেচাকেনা হওয়ার এক মাসের মধ্যে তা নথিবদ্ধ করতে হবে।’

 

সিলেট সাবরেজিস্ট্রি অফিসে থাকা প্রায় দেড় হাজার পৃষ্ঠার এই বালাম বইগুলোর অধিকাংশ দলিল নাগরী লিপি, উর্দু, ফারসি, ব্রজবুলি ও সংস্কৃত ভাষায় লেখা। যার বেশির ভাগই তৎকালীন জমি কেনাবেচার তথ্য। এর মধ্য থেকে বের হয় ৩টি মানুষ বিক্রির দলিল। এ অফিসের মহাফেজখানার পাঁচটি বালাম বই পড়ে উদ্ধার করা হয় ১৮০৬ সালের একটি ও ১৮০৭ সালের দুটি দলিল।

 

শ্রীহট্ট সংস্কৃত কলেজের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ অধ্যাপক দিলীপ কুমার দাশ চৌধুরীর অনুবাদের পর তা পুনরায় যাচাই করা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগের দ্বারা। এই তিনটি দলিলেই আছে অভাবের কারণে মানুষ বিক্রির ইতিহাস। এ প্রসঙ্গে উঠে আসে সে সময় বাংলার অন্যান্য অঞ্চলে বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে মানুষ বিক্রির তথ্যও।

 

মানুষ বিক্রির চার দলিলের একটিতে তৎক্ষালীন শেখ বিআনিয়া নামক ২৫ বছরের এক যুবকের জবানবন্দিটি লেখা ছিলো- আজীবন সে দাস থাকবে। কাজে গাফিলতি করবে না। আর পালিয়ে গেলে ধরে এনে মনিব যে শাস্তি দেবে, সে মাথা পেতে নেবে।

 

বিআনিয়ার মৌখিক স্বীকারোক্তির পরিপ্রেক্ষিতে লেখা হয়েছিল মানুষ বিক্রির সেই দলিল। ফয়েজউল্লাহ নামে স্থানীয় এক ব্যক্তি মাত্র ৪০ কাহন কৌড়ি অর্থাৎ সে সময়ের ১০ রুপিতে দাস হিসেবে কিনে নিয়েছিলেন শেখ হাবিবের ছেলে শেখ বিআনিয়াকে। বিআনিয়া জানিয়েছিল, কর্জ শোধের জন্য বিক্রি করছেন নিজেকে। ১৮০৬ খ্রিষ্টাব্দ, বাংলা ১২১৩ সালের ১ পৌষ নথিভুক্ত হয় এ দলিল।

 

১৮০৭ সালে পরপর দুই দিন লেখা হয়েছিল মানুষ বিক্রির আরও দুটি দলিল। কেন্দরাম ও গঙ্গারাম নামে দুই ভাই কিনেছিলেন ১৭ বছরের গনাই ভান্ডারিকে। অনুপ রায় বেপারি নামে এক ব্যক্তির কাছ থেকে ২৫ টাকায় কেনা হয়েছিল গনাইকে।

 

এই দলিলটি দাস হিসেবে পরবর্তী প্রজন্মের আগেই বিক্রি হওয়ার এক ইতিহাস বটে। গনাইয়ের সন্তান হলে তাঁরাও একই মালিকের ক্রীতদাস হবে বলে শর্ত দেওয়া আছে নথিতে। ১৮০৭ খ্রিষ্টাব্দে, বাংলা ১২১৩ সালের ৫ ফাল্গুন এই বেচাকেনা নথিবদ্ধ হওয়ার মাত্র এক দিন আগে বিক্রি হয়েছিল মা আর ছেলে। তাদের মূল্য ছিল গনাইয়ের প্রায় অর্ধেক।

 

সনাই দাষ তীর্ত্ত স্বীকারোক্তি দিয়েছেন, মা ভূবিদাসীসহ নিজেকে বিক্রি করছেন বাধ্য হয়ে। শ্রীহট্টের (সিলেট) বীনারপুরের মামুদপুরের বিনোদরাম দাস ও খনারাম দাস নামে দুই ভাই কিনেছিল ভূবিদাসী আর তাঁর ছেলে সনাইকে। দুজন মানুষের দাম নির্ধারণ হয়েছিল মাত্র ২৮ টাকা।

 

তিনটি দলিল পর্যালোচনা করে দেখা যায়, আঠারো শতকের শুরুতে কেউ প্রথমবার বিক্রি হয়েছেন দাস হিসেবে। কারও ক্ষেত্রে ঘটেছে শুধু মনিব বদলের ঘটনা। ১৮০৬-১৮০৮ সালের ২৩২ পৃষ্ঠার বালাম বইয়ের ৩৪, ৮০ ও ৮১ নম্বর পৃষ্ঠার দলিল তিনটি সিলেটের অভ্যন্তরে মানুষ কেনাবেচার।

 

এই দলিল তিনটি উদ্ধারের সূত্র ছিলো- ১৮০১ সালে মানুষ কেনাবেচার আরেকটি দলিলের কপি। সেই চতুর্থ দলিলটিও পাওয়া গেছে আরেক বালাম বইতে। ৩৫ বছরের নব দাসী আর তাঁর ৯ বছরের কন্যা অমরা দাসীর বিক্রি হওয়ার নথি সেটি। এটি সিলেট সদর সাবরেজিস্ট্রি অফিসের বালাম বইয়ে থাকা মানুষ বেচাকেনার সবচেয়ে পুরোনো দলিল।

 

জানা গেছে, বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরে এবং সিলেটের ভাষাসৈনিক মতিন উদ্দীন আহমদ জাদুঘরে রাখা আছে মানুষ বিক্রির দুটি দলিল। জাতীয় জাদুঘরের দলিলটি ইংরেজি ১৮০৮ সালের। ময়মনসিংহে ১৩ টাকায় ৬ বছরের কন্যাশিশুর বিক্রির ইতিহাস। মতিন উদ্দীন জাদুঘরের নথিটি ১৮৩৬ সালে সিলেটের জকিগঞ্জে ১২ বছরের কন্যাশিশুর ১১ টাকায় বিক্রি হওয়ার তথ্য।

 

এ ছাড়া এ অঞ্চলের চট্টগ্রাম ও তৎকালীন বিক্রমপুর, বর্তমান মুন্সিগঞ্জে লিখিতভাবে মানুষ বেচাকেনা হতো বলে জানা যায়। অচ্যুতচরণ চৌধুরী তত্ত্বনিধি রচিত শ্রীহট্টের ইতিবৃত্ত: উত্তরাংশ এবং শ্রীহট্টের ইতিবৃত্ত: পূর্বাংশ দুই খণ্ডের মধ্যে আছে মানুষ বিক্রির আরও দুটি দলিল। বিভিন্ন স্থানে যেমন মানুষ বিক্রির দলিলের সন্ধান পাওয়া যায়, তেমনি মানুষ কেনার জন্য বিজ্ঞাপন দেওয়ার নমুনাও রয়েছে পুরোনো সংবাদপত্রে। এমন একটি বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হয়েছিল তৎক্ষালীন বেঙ্গল গেজেট পত্রিকায়। সেখানে কলকাতাবাসী জনৈক ভদ্রলোকের জন্য সুদেহী দুই নারী চাওয়ার বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হয়েছিল ১৭৮০ থেকে ১৭৮২ সালের মার্চের মধ্যে কোনো একদিন।

 

১৮২৫ সালের ১৮ জুন বাঙ্গালা সমাচারপত্র সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয় কন্যা বিক্রির একটি খবর। ৩ বছর পর ১৮২৮ সালের ১১ অক্টোবর প্রকাশ হয় ভার্যা (স্ত্রী) বিক্রির খবর। তুলার মূল্যবৃদ্ধিতে আতঙ্কিত হয়ে নিজের স্ত্রীকে এক যুবকের কাছে কিছু টাকায় বিক্রি করেছিলেন বর্ধমানের এক ব্যক্তি। ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পাদিত সংবাদপত্রে সেকালের কথা বইতে পাওয়া যায় এসব তথ্য।

 

এদিকে, এ অঞ্চলের মানুষ বেচাকেনার ১৭৯০ সালের একটি দলিল পাওয়া যায় চৌধুরী হারুন আকবরের লেখা আভিজাত্যে সিলেটী সমাজ বইয়ে।
২৩২ বছর আগের ওই দলিলে আছে, জমিয়ত নামে চার বছরের এক শিশুর বিক্রির ইতিহাস। অভাবের কারণে নিজের সন্তানকে মাত্র ৫ কাহন কৌড়িতে বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছিলেন হবিগঞ্জের নবীগঞ্জের দিনারপুরে পরগনার এক অসহায় বাবা।

 

এছাড়াও ১৮০১ থেকে ১৮০৭ সালের মধ্যে এ অঞ্চলে এক দাসী ও তাঁর ছেলে নিজেদের বিক্রি করেছিলেন মাত্র ২৮ মণ ধানের মূল্যে।

গুণ গত মান যার ভাল তার দাম একটু বেশি সিলেটের সেরা বাগানের উন্নত চা প্রতি কেজি চা দাম ৪৫০ টাকা হোম ডেলি বারি দেয়া হয়

tree

কম খরচে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিন

কম খরচে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিন