সামর্থ্যের চেয়েও বেশি কিছু নিয়ে ‘হেক্সা’ মিশনে ব্রাজিল

প্রকাশিত: ২:২৩ অপরাহ্ণ, নভেম্বর ১৬, ২০২২

সামর্থ্যের চেয়েও বেশি কিছু নিয়ে ‘হেক্সা’ মিশনে ব্রাজিল

অনলাইন ডেস্ক : পাঁচবারের বিশ্বকাপজয়ী ব্রাজিল এবারের আসরে সবচেয়ে শক্তিশালী দল নিয়ে মাঠে নামবে। সেলেসাওদের সবচেয়ে বড় শক্তি তাদের আক্রমণভাগ।

যেখানে আছেন নেইমার-ভিনিসিয়ুস-রদ্রিগো-রাফিনিয়া-আন্তনির মতো ফর্মে থাকা ফরোয়ার্ডরা। একই সঙ্গে অভিজ্ঞ কোচ তিতে তো আছেনই। ঠিকঠাকভাবে যদি পরিকল্পনা কাজে লাগাতে পারেন তিনি; ‘হেক্সা’ জিততে পারে ব্রাজিল।

 

তারকায় ভরপুর এই স্কোয়াডের গভীরতা কতটা শক্তিশালী। আজ সেটিই তুলে ধরবো আপনাদের সামনে। ফিফা র‌্যাংকিংয়ের শীর্ষে থাকা এই দলের দায়িত্বে থাকা অভিজ্ঞ কোচ তিতেকে নিয়েই প্রথমে কথা বলা যাক।

 

সেলেসাও কোচ তিতে
ছয় বছর দলকে এই দলকে টেনে নিয়ে যাওয়া তিতে বিশ্বকাপের পরেই ছাড়তে পারেন দায়িত্ব। তবে এর আগে দলকে ‘হেক্সা’ জেতাতে বদ্ধ পরিকর তিনি। গত বিশ্বকাপে ছুটতে থাকা ব্রাজিলের স্বপ্নভঙ্গ হয় কোয়ার্টার ফাইনালে। বেলজিয়ামের বিপক্ষে সেই ২-১ ব্যবধানে হারের পর মনোবল ভেঙে পড়েছিল তিতের। তবে পেছন ফিরে তাকাননি এই কোচ। মনোবল বৃদ্ধি করে টানা দুইবার কোপা আমেরিকার ফাইনালে উঠান দলকে।

ছয় বছর ধরে ব্রাজিলকে ধাপে ধাপে এগিয়ে নিচ্ছেন তিতে

ছয় বছর ধরে ব্রাজিলকে ধাপে ধাপে এগিয়ে নিচ্ছেন তিতে

 

২০১৯ সালে লাতিন আমেরিকার সর্বোচ্চ প্রতিযোগিতায় পেরুকে ৩-১ ব্যবধানে হারিয়ে ব্রাজিলের ১২ বছরের শিরোপা খরা মেটান তিতে। পরের বছরও ফাইনালে ওঠে সেলেসাওরা। তবে সেবার আর্জেন্টিনার বিপক্ষে আর পেরে ওঠা হয়নি তাদের। হারতে হয় ১-০ ব্যবধানে।

 

৬১ বছর বয়সী এই কোচ ব্রাজিলের কয়েকটি প্রজন্মকে কোচিং করিয়েছেন। দলের সঙ্গে মিশেছেন; দলকে প্রেরণা যুগিয়েছেন। তাইতো ফুটবলারদের খুব ভালো করেই চেনা তার। যে কারণে দলকে নিজের কৌশলের মাধ্যমে পরিচালনা করতে বেগ পোহাতে হবে না তার। একথা তাই বলাই যায়, অভিজ্ঞ এই কোচ কাতার বিশ্বকাপে যাওয়ার আগেই কি কৌশল অবলম্বন করতে হবে তা ভালোভাবেই দলের সবার মাথায় সেট করে দেবেন।

 

বদলি স্কোয়াডের ডেপথ্
ব্রাজিলের নিয়মিত একাদশ যে শক্তিশালী তা-ই নয়, বরং দলটির বেঞ্চও বিশ্বের অন্যতম সেরা। ইউরোপের শীর্ষ ক্লাবগুলোতে ফর্মে থাকা ফরোয়ার্ড, মিডফিল্ডার, ডিফেন্ডারে ভরপুর সেলেসাওদের এবারের বিশ্বকাপ স্কোয়াড। গোলরক্ষকের কথা চিন্তা করলে লিভারপুলে দারুণ খেলতে থাকা আলিসন বেকারের বদলি হিসেবে আছেন ম্যানচেস্টার সিটির হয়ে প্রিমিয়ার লিগ ঘরে তোলা এদারসন। এই দৌড়ে আছেন ফর্মে থাকা ওয়েভারতনও।

বদলি হিসেবে নেমে ম্যাচজয়ের নায়ক বনে যেতে পারেন তরুণ রদ্রিগো

বদলি হিসেবে নেমে ম্যাচজয়ের নায়ক বনে যেতে পারেন তরুণ রদ্রিগো

সেন্টার-ব্যাকে মার্কিনিয়োস, সিলভার অভিজ্ঞতার সঙ্গে লড়তে হবে রিয়ালের হয়ে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জেতা মিলিতাওকে। আরেক ডিফেন্ডার ব্রেমারও আছেন দারুণ ফর্মে। বদলি হিসেবেও তাকে দেখা যাবে মাঠে। রাইট-ব্যাকে সবচেয়ে অভিজ্ঞ ফুটবলার দানি আলভেসের সঙ্গে জায়গা নিয়ে লড়াই করতে হবে দানিলোকে। যিনি সান্তোসের হয়ে কোপা লিবার্তোদোরেস জয়ের পর রিয়ালের হয়ে জেতেন চ্যাম্পিয়নস লিগ। ম্যানচেস্টার সিটিতে গিয়েও প্রিমিয়ার লিগ জেতেন এই ডিফেন্ডার। এরপর জুভেন্টাসে যোগ দিয়ে দলের অন্যতম ডিফেন্ডার বনে গেছেন তিনি।

 

লেফট-ব্যাকে আলেক্স সান্দ্রোর পাশাপাশি বদলি হিসেবে রয়েছেন অ্যালেক্স তেলেস। জুভেন্টাস ও সেভিয়ার এই দুই ডিফেন্ডারের মধ্যে অভিজ্ঞতা থেকে সামর্থ্য নিয়েই লড়াই হবে বেশি। এছাড়া মিডফিল্ডে থাকা ব্রাজিলিয়ান কাসেমিরো, ফাবিনিয়ো ও ফ্রেদের পাশাপাশি বদলি হিসেবে রয়েছেন ব্রুনো গিমারেস, লুকাস পাকেতা, ও এভেরতন রিবেইরো।

 

অ্যাটাকিংয়ে সবচেয়ে শক্তিশালী ব্রাজিলের নিয়মিত একাদশের বাইরে রয়েছেন রিয়াল মাদ্রিদের রদ্রিগো। গত মৌসুমে স্প্যানিশ এই জায়ান্টদের রেকর্ড ১৪তম চ্যাম্পিয়ন্স লিগে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন তিনি। বদলি হিসেবে নেমে গোল করে দলকে জেতানোর সেই সক্ষমতা রয়েছে তরুণ এই ফরোয়ার্ডের। তার পাশাপাশি আর্সেনালে খেলা মার্তিনেল্লিও আছেন দুর্দান্ত ফর্মে। একই ক্লাবে খেলা আর্সেনালের গাব্রিয়েল জেসুস হতে পারেন রিচার্লিসনের বদলি। গানারদের হয়ে চলতি মৌসুমে উড়ছেন যিনি। এছাড়া রাফিনিয়া তো আছেনই! আন্তনি, নেইমার, ভিনিসিয়ুসের সঙ্গে জায়গা নিয়ে লড়াই করতে হবে তাকেও।

 

সেলেসাওদের শক্তিমত্তা
কাতার বিশ্বকাপে ব্রাজিলকে যদি সবদিক থেকে টপকাতে পারে; তবে একমাত্র ফ্রান্সের নামই সামনে আসবে। তবে বিশ্বকাপের আগে দলটির ইনজুরির তালিকা বাড়ছে। এটি হতে পারে সেলেসাওদের সবচেয়ে বড় সুযোগ।

 

একটা সময় গোলরক্ষক নিয়ে সমস্যায় ভূগেছিল ব্রাজিল। ১৯৫০ বিশ্বকাপে মারাকানায় উরুগুয়ের বিপক্ষে পুরো দেশকে কাঁদিয়েছিলেন সেবারের গোলরক্ষক মোয়াসির বারবোসা। কিন্তু বর্তমান গোলরক্ষক কোচ ক্লদিও তাফারেল এবং দিদা এই সমস্যার সমাধান এনে দিয়েছেন। যে কারণে খুব সহজেই একাদশে আলিসন ও এদারসনকে নিয়ে শঙ্কামুক্ত থাকতে পারেন কোচ তিতে।

 

যে বিষয়টি ভাবনার কারণ হতে পারে ব্রাজিলের তা হলো ডিফেন্স। যদি থিয়াগো সিলভা ও মার্কিনিয়োস ইনজুরিতে না পড়েন। অবশ্য অভিজ্ঞ এই দুই ডিফেন্ডারের বদলি হিসেবে নিজেদের প্রমাণ দিতে হবে মিলিতাও ও ব্রেমারকে। গত মৌসুমে রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জেতা মিলিতাওয়ের পাশাপাশি ইতালিয়ান সিরি আ’তে রাজত্ব করা ব্রেমার যদি চেনা ফর্মে থাকেন। তবেই চিন্তামুক্ত সেলেসাওরা।

 

রোনালদো নাজারিওর অবসরের পর স্ট্রাইকার হিসেবে নিজেকে প্রমাণ দিয়ে যাচ্ছেন রিচার্লিসন। এর প্রমাণ ইতোমধ্যে দিয়েছেন তিনি। ২০১৯ সালের কোপা আমেরিকা জয়ে বড় অবদান ছিল টটেনহ্যামের এই তারকা স্ট্রাইকার। এছাড়া ফর্মে থাকা জেসুস তো আছেনই বদলি হিসেবে। আক্রমণভাগের শক্তিমত্তার বিচারে এবারের বিশ্বকাপে ব্রাজিল থেকে এগিয়ে কেউ নেই বলাই যায়!

 

ব্রাজিলের দুর্বলতা
তিন বছর আগে সবশেষ কোনো ইউরোপীয় দলের সঙ্গে আন্তর্জাতিক ম্যাচে মুখোমুখি হয়েছিল ব্রাজিল। এরপরই করোনা ভাইরাস হানা, তাছাড়া অনুষ্ঠিত হয় উয়েফা ন্যাশনস লিগও। যে কারণে ইউরোপিয়ান দল মোকাবিলায় ব্রাজিল কতটা পেরে উঠবে, তা নিয়ে রয়েছে শঙ্কা। যদিও লাতিন আমেরিকার আরেক দল আর্জেন্টিনা উয়েফা ইউরো চ্যাম্পিয়ন ইতালিকে হারিয়ে ‘ফিনালিসিমা’ জিতে নেয়, সেটি হতে পারে ব্রাজিলের জন্য আশার আলো হতে পারে।

নেইমারের ইনজুরির দুশ্চিন্তা মাথায় নিয়েই মাঠে নামতে হবে ব্রাজিলকে

নেইমারের ইনজুরির দুশ্চিন্তা মাথায় নিয়েই মাঠে নামতে হবে ব্রাজিলকে

 

এদিকে লেফট-ব্যাক নিয়ে কিছুটা দুশ্চিন্তায় রয়েছে সেলেসাওরা। দলের অন্যতম ভরসা রেনান লোদি ২০২১ সালে কোপা আমেরিকায় বড় ধরনের ভুল করে বসে। যে ভুলের কারণে শিরোপা জেতা হয়নি দলটির। এদিকে আলেক্স সান্দ্রোও ইউরোপিয়ান দলগুলোর বিপক্ষে লড়তে বেশ পরিপক্ক নন। অপরদিকে আরেক লেফট-ব্যাক আলেক্স তেলেসকে সবশেষ আন্তর্জাতিক প্রীতি ম্যাচগুলোতে খেলান তিতে। এর আগে ম্যাচ না খেলায় অভিজ্ঞতার দিক থেকে পিছিয়ে এই লেফট-ব্যাকও।

 

নেইমারকে নিয়েও কিছুটা দুশ্চিন্তায় রয়েছে ব্রাজিল। ২০১৪ বিশ্বকাপে জার্মানির বিপক্ষে ৭-১ ব্যবধানে হারের সেই ম্যাচে মাঠে নামতে পারেননি পিএসজির এই ফরোয়ার্ড। এর আগে তাকে বাজেভাবে আঘাত করেন কলম্বিয়ার ফুলব্যাক হুয়ান কামিলো জুনেগা। সেসময় মেরুদণ্ডের হাড়ে চিড় ধরে নেইমারের। সেই ইনজুরি এখনও ভোগাচ্ছে ব্রাজিলিয়ান এই সুপারস্টারকে। তাছাড়া গোড়ালির চোটে ২০১৯ সালের কোপা আমেরিকার একটি ম্যাচেও থাকতে পারেননি তিনি। যদিও তিতে এটিকে উড়িয়ে দিয়েছেন। তার আশা নেইমার ফিরবেন স্বরূপেই।

 

‘হেক্সা’ মিশন
২০ বছর পেরিয়ে গেল, বিশ্বকাপ জেতার আক্ষেপ মেটানোর সময় এসে গেছে। বিশ্বের সবচেয়ে সফল ফুটবল দলের জন্য এই সময়টা অনেক বেশি দীর্ঘ। ফুটবলের দেশ খ্যাত ব্রাজিলের এইতো সময় শিরোপা আরও একবার ঘরে তোলার। সমর্থকার এই শিরোপা যাত্রাকে নামকরণ করে ‘হেক্সা’ হিসেবে। কাতার বিশ্বকাপ জিতলেই ব্রাজিলের জন্য হবে ষষ্ঠতম।

 

২০১৪ বিশ্বকাপে জার্মানির বিপক্ষে সেই ৭-১ ব্যবধানের হার, ১৯৫০ বিশ্বকাপে মারাকানায় ঘরের মাঠে উরুগুয়ের বিপক্ষে হরে স্বপ্নভঙ্গ; এসব কিছু চাপিয়ে নতুন লক্ষ্যে কাতার যাত্রা করবে ব্রাজিল। তবে কি কাতারের মাটিতে পেলে-রোনালদোদের উত্তরসূরি হতে যাচ্ছেন নেইমার-ভিনিসিয়ুসরা? সময়ই বলে দেবে এই প্রশ্নের উত্তর।

 

সূত্র, বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম