প্রকাশিত: ৬:৪১ পূর্বাহ্ণ, জুলাই ৯, ২০২৫
আফতাব চৌধুরী : পরিবর্তনকোথায় নেই। শুধুই কি দুঃখ-সুখ চক্রবৎ পরিবর্তশীল ? কথাটা মনে পড়ল বাঙালি জাতটার কথা ভেবে। আর্থিক জীবনে বাঙালির, পরিবর্তন ঘটেছে। বিচ্ছিন্নতাবাদের চিন্তাধারার আত্মপ্রকাশ ঘটেছে তার মধ্যে। অশন-বসনে বৈচিত্র্য এসেছে। বাঙালি আজ নিজ ভূমেই পরবাসী। বঙ্গভূমে তার বাসস্থানের অভাব ঘটেছে। উদ্যম-উৎসাহে ভাটা পড়েছে। বাঙালির সংগ্রামী মন আজ বিপদগামী। ভিন্নমতাদর্শী দলের সঙ্গেই শুধু নয়, নিজে দলের মধ্যেই প্রবল থেকে প্রবলতর হচ্ছে মতানৈক্য, দ্বন্ধ, সংঘর্ষ।
আত্মকলহে লিপ্ত বাঙালি কাদের সুবিধে করে দিচ্ছে ? উত্তরটা অতুল সুর অনেক আগেই দিয়েছেন, ‘বাঙালি আজ আত্মকলহে প্রমত্ত হয়ে অগ্রগতির সুযোগ ও সুবিধা করে দিচ্ছে অপরকে। এ আত্মকলহ আজ এমন একটা স্তরে গিয়ে পৌছেছে যে পরস্পর পরস্পরকে গালিগালাজ দেওয়াটাই প্রতিভার একটা বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাঙালির এই পরিচয় কিন্তু সর্বযুগের নয়। এক সময় বাঙালির আত্মপ্রত্যায়ের অভাব ছিল না। তার জীবনচর্যায় ও সংস্কতিতে স্বকীয়তা ছিল। বহুরূপীর মতো এই জাতটা ঘনঘন রূপ বদল করেনি কোন সময়ই। অতীতে গৌরবময় সংস্কৃতির অধিকারী হয়ে বাঙালি মানবসভ্যতাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করেছে। কিন্তু আজ ?
বড় বেদনাময় অভিজ্ঞতার কথা বলি। বছর কয়েক আগে এ সিলেটের এক পিসিও-র পাশের ঘরে বসে আছি। রাস্তার উপরে ঘর। দেখি সত্তরোর্ধ্ব এক ভদ্রলোক কাউকে ফোন করার জন্য পিসিও-র মালিককে অনুরোধ করলেন, ‘ভাই আমি কানেকম শুনি, ফোনের সাউন্ডটাকে একটু বাড়িয়ে দিন।’ স্পষ্ট শুনলাম বৃদ্ধ কর্মরত তাঁর একমাত্র পুত্রকে বলছে, ‘বাবা, তোর মার অবস্থা এখন-তখন। একবার শেষ দেখা দেখে যা।’ উত্তরটা ওপার থেকে স্পষ্ট কানে এল, ‘বাবা এটা তো প্রাকৃতিক ব্যাপার। মা’র বয়স হয়েছে। একদিন তাকে তো যেতেই হবে। আমি এখন ছুটি পাব না। কয়েকদিন পরে আসব।’ দিন কয়েক পর ভদ্রলোকের সাথে হঠাৎ একদিন এক ফার্মেসিতে দেখা। পরিচয় গোপন করে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘আপনার ছেলের মা এখন কেমন আছেন ? ভদ্রলোক খানিকটা হকচকিয়ে গেলেন। তখন পিসিও’র প্রসঙ্গ তুলতেই তিনি বললেন, আমি এখন একা। কয়েকদিন আগে আমার স্ত্রী-বিয়োগ ঘটেছে। মায়ের মৃত্যুর খবরে ছেলেটি আসেনি। জানি না, আমার মৃত্যুর পর সে জানাজাতে শরীক হবে কিনা।
আজকের বাঙালির সব কিছুই কি তবে খারাপ ? লাখ টাকার এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার আগে আসুন বর্তমান বাঙালি-জীবনের আরও গুটি কয়েক কথা জেনে নিই। গত শতাব্দী তিন-চার দশকে ‘কফি প্রমোশন বোর্ড’ কফির প্রচারের জন্য বিনামূল্যে কফি খাওয়ালেও বাঙালি চায়ের নেশায় ডুবেছিল। কফি হাউসের আড্ডাটা ছিল মুষ্টিমেয় বাঙালির। আবার চা-এখন সর্বস্তরের বাঙালির পানীয় হলেও তারা সনাতন পানীয় ছিল ঘোল, লেবুর শরবত ও বেলের পানা। তরমুজের শরবত, কাঁচা আম গোড়ার শরবতও এক সময় বাঙালির প্রিয় ছিল। এর পর এল চা। কোথাও গøাসে-এখন ‘ওয়ান টাইম’-এ।এর পর বাঙালি বোতল ধরল। সফট ড্রিংকস পান শুরু হল। কোকোকোলার বোতল, থামস-আপ এর বোতল, স্প্রাইটের বোতল, মিরিন্ডার বোতল এবং বাহুল্য মিনারেল ওয়াটারের বোতল। মাঝে কিছুদিন চলেছিল সোডা-ওয়াটারের বোতল। আমার মতো বয়স্ক মানুষেরা সেই বোতলের মুখখোলার ‘চুই’ শব্দটি আজও ভোলেননি হয়তো। এ পর্যন্ত সবই মোটামুটি ঠিক আছে। পরিবর্তনের রথের আসনে বসেই বাঙালি বিশ্বজগতে তার পরিচয়টি তুলে ধরেছিল। কিন্তু আজ বাঙালি তার রথের আসনে বসে নেই, রথের চাকায় পিষ্ট হয়েছে। জাতটা এখনও মরেনি, তবে কার নাভিশ্বাস উঠেছে। কালিমার্কা পাকি মদের বোতলটা তখনও ‘উচ্চ’ বাঙালি সমাজে রুক্ষে পায়নি। তবে হ্যাঁ, ইংরেজদের সংস্পর্শে এসে ‘উচ্চ সমাজ্যসীন’ বাঙালি রক্তিম বর্ণের সুরাপান শুরু করেছিল। এই লাল পানি ও পাকি মদ পদ পানে ধর্মীয় বা সামাজিক কোনো না-কোন বাধা ছিল। কিন্তু আজ ? ধন্য রথচক্র পিষ্ট বাঙালি। বহু প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করে তুমি আজ মদ্যপ অবস্থায় সমাজে প্রবেশ করেছ। সদ্যযৌবন প্রাপ্ত বাঙালিও আজ সুরের নেশার সাথে সুরার নেশাকে মেলাচ্ছে।অথচ ভাবুন, এমন একটা সময় ছিল যখন বঙ্গদেশে প্রস্তুত নানাবিধ মদের যথেষ্ট খ্যাতি ছিল তখনও কিন্তু বাংলায় মদ্যপানকে নিচু চোখে দেখা হত। আর আজ এ-বিষয়ে বাঙালি নির্লিপ্ত হয়ে গেছে। উচ্চ বাঙালি সমাজে এখন মদ্যপান আর দিনগত রীতিমাত্র নয়, ‘স্ট্যাটাস সিম্বল।’
এখন দিন কাল বদলেছে। বাঙালি-সুন্দরীরা এখন আর তেল-কাজল-আলতায় নিজেদের রূপসী করে তোলেন না। এখন প্রয়োজন রোজ একবার করে এসে মেশিনে ওজোন থেরাপি, তারপরে চুলে একটা টনিক ম্যাসেজ, আর চার দিন বাদে বাদে একটা করে প্যাক। ব্যাস, হয়ে গেল সৌন্দর্যের টোটার এক্সপ্লোরেশন ! বাঙালি রূপসাগরে ডুব দিয়েছে। বাঙালি শহর আছে ইউনিসেক্স পার্লার-যেখানে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে রূপ নিয়ে মাঝাঘষা করছে বাঙালি নারী-পুরুষ। মন্দ নয়। শুধু বলি, বাঙালি নারী-পুরুষ আজ রক্ষণশীলতার গন্ডিটুকু পার হোক। মেয়েরা সাজুক, রূপচর্চা করুক। কিন্তু এমনভাবে সাজাটাই শ্রেয় যেন পুরুষ কখনও অশোভন দৃষ্টিতে নারীর দিকে তাকাতে না পারে । অনেক কট্টর নারীবাদীরাও কিন্তু এই বিশ্বাসে সুস্থির।
বাঙালি শুধু রূপসাগরে ডুব দেয়নি। নব্য মধ্যবিত্ত বাঙালির মধ্যে ঢুকেছে গাড়ির নেশা। গত শতকের নয়ের দশকে মধ্যবিত্তের মাইনে বেড়েছে অনেক। স্বামী-স্ত্রী দু‘জনেই কাজ করলে তখন দু‘জনের ছ‘মাসের মাইনেতে নতুন গাড়ি কিনা যেত। আজ গাড়ির দাম বেড়েছে-বেতন বৃদ্ধিও ঘটেছে যথেষ্ট। সুতরাং আজ যদি মধ্যবিত্ত বাঙালি ছোট গাড়ি কিনে- এমনকি যাদের মাইনে ততটা বাড়েনি তারাও যদি গাড়ি কেনার কথা ভাবে তাহলে মাল্টি-ন্যাশনাল কার কোম্পানিগুলো অবশ্যই তাদের হিসাবের মধ্যে রাখবে।
বাড়ির কথাটাও এসে যায় এ – প্রসঙ্গে। একসময় বলা হত সাহেবের গাড়ি, বাঙালির বাড়ি আর মুসলমানের হাঁড়ি তাদের আভিজাত্যের পরিচয়। বাঙালির বাড়ি যে কতখানি আভিজাত্যে ভরা তার প্রমাণ শুধু জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়ী, রাজ নগরের দেওয়ান বাড়ী,পৃথিম পাশের জমিদার বাড়ী বা সিমলের দত্ত বাড়ী, গুলশান,বারিধারার বাঙালি-বাড়ির ভিতর- বার দেখলেই বোঝা যায় এই শৌখিন জাতটার শুধু জন্ম হয়নি, রঙ বদলেছে। কিন্তু এ সবই তো বাইরের চাকচিক্য। ভদ্রলোক বাঙালিরা পুরনো মূল্যবোধ নিয়ে বসে নেই। কিন্তু বিকল্প মূল্যবোধের সুষ্ঠু কাঠামো কি তৈরি হয়েছে? বাঙালির নব প্রজন্ম নতুন সহ¯্রাব্দে তাদের অভিভাবকদের ছেড়েছে কিন্তু পেরেছে কি সাবালক হয়ে উঠতে ? আসলে সেই ব্যবধান তো এখনও ঘোচনি- সাহেব বাঙালি আর নি¤œবর্গীয় বাঙালি। বাঙালির ছেলে-মেয়েরা আজও উৎপাদকদের কাছে কাঁচামালই রয়ে গেল। হ্যাঁ, বাঙালী নন্দনে যায়, নজরুলসদনে যায়, অ্যাকাডেমিতে যায় ফিল্মোৎসবে যায়-গিয়ে দেখে সেই দৃশ্য-যেখানে জীবনযন্ত্রণায় কাতর, না-পাওয়ার হতাশায় ক্লিষ্ট বাঙালি জাতির সিংহভাগই কোণঠাসা। এরাই কিন্তু এখন সাহেব বাঙালিকে মানতে চাইছে না। এই হাওয়া ক্রমশ জোরদার হচ্ছে।
বিশ্বায়ন বা পণ্যায়নের যুগে বিনিময় মূল্যের দাপট সব বাঙালি দেখাতে পারছে না, পারছে কয়েকজন মাত্র। তারাই চেনা গৃহকোণ থেকে ছিটকে গেছে অথচ নতুন একটা ঘর খুঁজে পায়নি, পথ খুঁজে পাওয়া তো দূরের কথা। আসল কথা, এই বিশ্বায়ন তো নিতান্তই খন্ডিত, অসম্পূর্ণ, বিকৃত। তাই শতপুষ্প বাঙালির মধ্যে বিকশিত হতে পারেনি। পারলে বাঙালি নাচ-গানের অনুষ্ঠানের নামে রাজপথ জুড়ে প্যান্ডেল বানাত না, রাতে পিকনিকের নামে রাস্তায় মাইক বাজিয়ে আশপাশ এলাকার পরিবেশ নষ্ট করতনা, সত্তর মাইল বেগে মটর সাইকেল চালিয়ে দুর্ঘটনা ঘটাতনা। আজকের বাঙালি দরজা-জানালা মাঝে-মধ্যে খুলে দেয় বটে, খোলা বাতাস বুক ভরে নিতে চায়, কিন্তু বাতাসে আর কী কী ভেসে আসছে তার কিছুমাত্র বিচার বিবেচনা করে না।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিষ্ট।




অফিস : ৩৭০/৩,কলেজ রোড,আমতলা, আশকোনা,ঢাকা-১২৩০,
Call : 01911120520
Email : info.sylhet24express@gmail.com
প্রধান উপদেষ্টা : আলহাজ্ব মোহাম্মদ কাপ্তান হোসেন
পরিচালক, সিলেট উইমেন্স মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও প্রতিষ্ঠাতা, আলহাজ্ব মোহাম্মদ কাপ্তান হোসেন সমাজ কল্যাণ ট্রাস্ট।
উপদেষ্টা সম্পাদক : মো. রেজাউল ওয়াদুদ চেয়ারম্যান বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন পরিষদ (বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস এনফোর্সমেন্ট কাউন্সিল)
সম্পাদক ও প্রকাশক মো: আবু বক্কর তালুকদার
ব্যবস্থাপনা সম্পাদক : নূরুদ্দীন রাসেল
Design and developed by Web Nest