প্রবাসীর ঈদ

প্রকাশিত: ৭:০৭ অপরাহ্ণ, এপ্রিল ১৫, ২০২৪

প্রবাসীর ঈদ

মুহাম্মদ আনোয়ারুল ইসলাম আনোয়ার : ঈদ নামক উৎসব মুসলমান মুমিনজনের হৃদয় নিংড়ানো এক অনন্য আনন্দ মূখর সমাবেশ। ইসলাম ধর্মের প্রবর্তক আমাদের প্রিয় রাসুল মুহাম্মদ (স:) মুসলমানদের জন্য আল্লাহ প্রদত্ত দুটি মহান ঈদের সুসংবাদ প্রদান করেন একটি হচ্ছে ঈদুল ফেতর ও অন্যটি ঈদুল আযহা। রমাদ্বান সৃষ্টিকর্তার একান্ত নিজস্ব মাস যা আল্লাহ রাব্বুল আলামীন নিজে তার জাযা বা উত্তম পুরস্কার প্রদানে মুমিনগনের সাথে অঙ্গীকারাবদ্ধ। দীর্ঘ প্রায় একমাস সিয়াম সাধনার মাধ্যমে মহান আল্লাহর একাগ্রতা হাসিলের এক ইহলৌকিক ইবাদতের উত্তম সুযোগ হচ্ছে রামাদ্বান যা তাকওয়া অর্জনে মানবকূলের এক অমিয় রাস্তা।

 

রোজা পরবর্তী প্রায় আড়াই মাস শেষে পালিত হয় বিশ্ব মুসলিমদের দ্বিতীয় উৎসব ঈদুল আযহা। ঈদুল আযহা হচ্ছে সহজ কথায় ত্যাগের মহিমায় নিজেকে আল্লাহর কাছে সমর্পন বা বিলিয়ে দেয়া অর্থাৎ যাঁদের সামর্থ থাকে পবিত্র হজ্ব পালন করা সেই সাথে কুরবানি প্রদান (হযরত ইব্রাহিম (আঃ) সর্বোচ্চ ত্যাগ হযরত ইসমাইল (আঃ) কে আল্লাহর রাস্তায় আত্মবলি যা অবশেষে মহান আল্লাহ দুম্বা কুরবানিতে পরিনত করেন।

 

পবিত্র ঈদুল আযহা অনেকটা সমাজের বিত্তশালী মানুষজনের উৎসব বলা যায় তবে এখানেও ঈদ জামাত পরবর্তী কুরবানির মাংস পাড়া-প্রতিবেশী আত্মীয়স্বজনসহ গরীব অসহায় মানুষজনের মাঝে বিলি-বন্টন করা হয় যা আমাদের অনাবিল ঈদ আনন্দে ভরিয়ে দিত।

 

হেন কাল থেকে ইসলাম ধর্মাবলম্বীরা পবিত্র ঈদুল আযহা ও ঈদুল ফেতর এই দুই ধর্মীয় ঈদে অনেক অনেক আনন্দ খুশিতে মাতোয়ারা।বিশেষ করে ছোটবেলার ঈদ আনন্দ খুশিতে ভরপূর ছিল একে অন্যের বাড়িতে বেড়াতে যাওয়া বা অন্যদের আসা নতুন জামা কাপড় পরিধান করা,গরীব অসহায়দের মধ্যে নতুন কাপড়-চোপড় বা নগদ অর্থ প্রদান এ যেন ছিল বাড়তি ঈদ আমেজ।সমস্ত দিনভর বন্ধুদের সাথে আড্ডা অহ কি নিদারুণ সময় কাটত।

 

মা-চাচীরা ঈদের সমস্ত আয়োজন সম্পন্ন করে যেন বসে থাকতেন প্রতিবেশী আত্মীয় স্বজনদের জন্য অথবা গরীব অসহায়দের কিভাবে কাপড়-চোপড় বা নগদ অর্থ প্রদান করা যায় সেই হিসেব কষতে।

 

সেইসাথে খুব ভোরে গোসল সারতে ডাকাডাকি আহ কি অদম্য প্রতিযোগিতা কে কার পূর্বে স্নান সেরে নতুন জামা পরে তৈরী হয়ে প্রথম মসজিদে অথবা ঈদগাঁহ যাবে আর শীতকাল হলেত গোসলের মজাই আলাদা সমস্ত শরীরে সরিষা তৈল মাখিয়ে ঐ ঘা ঝিমঝিম হিমশীতল গ্রাম্য পুকুরে ডুব দিতে হত।কিন্তু এখন তা অতীত, অহ প্রবাস!

 

একদা দেশান্তর বা স্থানান্তর আমাদের পূর্ব পূরুষগন বাঁকা চোখে দেখতেন তবে মাইগ্রেশন জ্ঞান অর্জন বা সভ্যতা আদান প্রধানের ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা সর্বজন স্বীকৃত। বর্তমানে আমাদের দেশের বিপুল সংখ্যক জনগোষ্ঠী বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিশেষ করে ইউরোপ আমেরিকা মধ্যপ্রাচ্য সহ পৃথিবীর প্রায় সকল মহাদেশে বসবাস করছেন।এটা একদিকে যেমন দেশের সাথে ভিন্ন সংস্কৃতির সংমিশ্রণে প্রভাব ফেলছে অন্যদিকে বিদেশী সংস্কৃতির আবির্ভাব ও প্রভাব আমাদের মাতৃভূমি আচ্ছাদন করছে।

 

এতে দেশ ও দেশের আপামর জনসাধারন উপকৃত হচ্ছেন সাথে দেশ বিতারিত মানুষজন যারা দেশের বাইরে তাদের কাক্ষিত স্বপ্ন শহরে কেউ সাময়িক নীড় গড়ে নিচ্ছেন কেউবা নিজভূমে ফেলে আসা আপনজনদের আবাস্থল গড়ায় অথবা উঁচ্চ শিক্ষায় আত্মীয়স্বজনদের নিজের হাড় ভাংগা খাটুনির পয়সাপাতি দিয়ে সাহায্য করা নয়তবা ব্যবসা সমুহের মূলধন যোগান দেয়া অথবা ঘনিষ্ট অলস প্রকৃতির স্বজনদের সুখ আহলাদ যোগান দিতে নিজেকে স্বাপ্নিক পরবাসে আকাশচুম্বী স্বপ্ন পুরনে নিত্য ব্যস্ত রাখা মাস শেষে দেশান্তরিত মানুষজনের এটাই রুটিন ওয়ার্ক।

 

এভাবে এক সময় প্রবাসীজন নিজের অলক্ষুণে জীবনের সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ বছরগুলি হারিয়ে শেষ বয়সে এসে কেউ হয়ত স্ত্রী সন্তানাদি সহ বিদেশ বিভূঁইয়ে অনিচ্ছা সত্ত্বে অবস্থার প্রেক্ষাপটে প্রবাসে থাকতে বাধ্য আর কিছু সংখ্যক প্রবাসী দেশে সুখ বা খ্যাতির আশায় সম্পদ গড়ে তুলেন।অন্যদিকে যারা জীবনের শ্রেষ্ট সময়টুকু স্বদেশভূমে নিজের আত্মীয়স্বজন বা ছেলেমেয়ের মুখের দিকে থাকিয়ে জীবন যৌবনের হিসেব কষতে ভুলে গেছেন তাদের প্রতি দেশ বা দেশের মানুষজনের আচরন অনেক ক্ষেত্রে সত্যিই হতাশাজনক!

 

অনেক ক্রেত্রে দেখা যায় প্রবাসী যারা বিভিন্ন ভাবে পরবাসী হয়ে পরেন রাষ্ট্র বা সরকারও সেক্ষেত্রে বিদেশীদের প্রতি সহানুভূতির চোখ রাখতে বেমালুম ভুলে যায় বা ইচ্ছে-অনিচ্ছা করে দায়িত্ব এডিয়ে যায়। ইংরেজী স্লোলক যা কথায় প্রচলিত আউট সাইড আউট অব মাইন্ড কিন্তু এখন মাইগ্রেইটেট মানুষজন যেন আউট অব প্রপার্টি বা আউট অব পারসোনাল রাইটে পরিনত, তাদের যে স্বপ্ন স্বাধ আহলাদ থাকতে পারে সেটা যেমন স্থানীয় মানুষ অর্থাৎ দেশ ও দেশের মানুষের কাছে অনধিকার চর্চায় পরিনত।

 

বিদেশী জনগোষ্ঠি বহুলভাবে রেমিটান্স যোদ্ধা হিসেবে রাজনৈতিক ব্যবহার্য শব্দায়নে উত্ফুল্ল আবার অনেক সময় রাষ্ট্রীয় প্রতিনিধির মাধ্যমে অহরহ ভাবে উচ্চারিত হয় প্রবাসীজন দেশের বাইরে একেক জন এমবেসেডর ।তবে রাষ্ট্র বা সরকার কখনও কি সেই সব দেশান্তরিত মানুষজনের কল্যানমূলক কোন কর্মসূচীর দিকে আলোকপাত করেছে না সর্বদা রাষ্ট্রও তার রাজনৈতিক মতাদর্শ লালনে সেই সব সুবিধা প্রাপ্ত লোকদের উচ্ছিষ্টে পরিনত। প্রবাসীরা সরকারের কাছ থেকে মহাভারত কিছু আশা করে না, আশা করে জাতি বা রাষ্ট্রের কাছ নাম মাত্র কিছু সেবা যা বিদেশে অবস্থানরত মিশন বা মিশন প্রধানের মাধ্যমে পাওয়ার। সেই ক্ষেত্রে আমাদের দেশের মিশনারীগন বহির্বিশ্বে চাকুরীর সুবাদে সাধারন প্রবাসী জনগনের সেবামূলক কর্মে কি কখনও আন্তরিক।

 

পাসপোর্ট বা ট্রাভেল পারমিট কথিত রেমিটেন্স যোদ্ধাদের বিদেশে নিত্য সহযোগী কিন্তু সেই পাসপোর্ট নামক দূষপ্রাপ্য বস্তটি পেতে কত যাতনা সইতে হয় তা কেবল ভূক্ত ভোগী ঐজন ছাড়া অন্য কারো পক্ষে কল্পনা করাও কঠিন।

 

অনেক সময় দেশ থেকে বাংলাদেশের মানুষ বিভিন্ন ভাবে বিদেশে আসার চেষ্টা করেন এবং পরবর্তীতে ঐদেশে কোনভাবে যখন থাকার বন্দোবস্ত হয় তখন প্রয়োজন পরে আবার দেশীয় পাসপোর্ট আর তখনই ঝামেলা,তবে ঝামেলা নেই যদি আপনি ঠিক জায়গামত উপযুক্ত উপটোকন দিতে পারেন অথবা আপনার কোন আত্মীয় ঐ মিশনে চাকুরী করেন।কদিন হল আমার এক পরিচিতজন বিলেতে স্থায়ী বসবাসের সুযোগ পান কিন্তু পাসপোর্ট ঝামেলায় মাত্র দুসপ্তাহর ব্যবধানে মাকে শেষ দেখা দেখতে যেতে পারেনি।সেস মেস মিশন ক্লিয়ারেন্স পেলেও দেশ থেকে মোটা অংকের উৎকোচ দাবী করে বসেন তথাকথিত পুলিশ ক্লিয়ারেন্সের নামে সংশ্লিষ্ট ডিপার্টমেন্টাল অফিসার।

 

স্বত্বাধিকার পরিবর্তনে পাওয়ার অব অ্যাটর্নির ক্ষেত্রে আমলাতান্ত্রিক জটিলতার অভিজ্ঞতা আরও ভয়াবহ। প্রবাসে প্রবাসীদের এ অভিজ্ঞতার তিক্ততা মোটামোটি সর্বজন স্বীকৃত। এটা হল মোটামুটি রেমিটেন্স যোদ্ধা হিসেবে বিদেশে অবস্থানরত রাজনৈতিক ভাষায় ব্যবহার্য প্রবাসী এক একজন কথিত এমবেসেডর খ্যাত হতভাগ্য দেশান্তরিত লোকদের বাস্তব অবস্তা। সরকার বা রাষ্ট্র প্রধান চাইলে প্রবাসে থাকা কমিউনিটির শ্রদ্ধাভাজন যে কাউকে দিয়েই পুলিশ ক্লিয়ারেন্স এর কাজ সারতে পারে সেক্ষেত্রে সাধারন লোকজনও উপকৃত হবে সময়ও অর্থ সাশ্রয় হবে দেশের প্রতি বিদেশী লোকজনের শ্রদ্ধাবোধও বাড়বে।

 

একবার দেশ ছাড়া হলে দেশের মানুষ ভাবে আমরা কেনইবা দেশ নিয়ে ভাবব প্রবাসী লোকদের কাজ হল কেবল দেশে বেড়াতে আসা আর পয়সা পাতি খরচ করা কিন্তু আমরা প্রবাসীরাতো বাংলাদেশেরই মানুষ এই সত্যটি মেনে নিতে কেন স্বদেশের লোকদের মধ্যে এত অস্বস্তি বা অবহেলা। প্রবাসে দক্ষ আর অদক্ষ সকল পর্যায়ে মানুষদের কি অমানবিক পরিশ্রম করতে হয় রাউন্ড দি ক্লক সেই সূত্রে মাঝে মাঝে ঈদ পর্বেও ছুটি মেলা কঠিন,অনেক ক্রেত্রে বাচ্ছাদের ঈদে স্কুল কলেজ কিংবা বিশ্ববিদ্যালয় যেতে দিতে হয় বা এক্সাম থাকে। জীবন জীবিকা আর দুনিয়াবী প্রতিষ্টা পেতে প্রবাসীরা অনেক ক্ষেত্রে মহান আল্লাহর ইবাদত বন্দেগী করার সুযোগ থেকে ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও বঞ্চিত, তারপরও আমরা খুশী আমাদের দেশ এবং দেশে লোকজনের ঈদ আনন্দে। সবাই ওভাল থাকুন ঈদ মোবারক।

 

মুহাম্মদ আনোয়ারুল ইসলাম আনোয়ার
লেখক, প্রাবন্ধিক, রাজনীতিক।