জলবায়ু পরিবর্তন ঝুঁকিতে উপকূলীয় এলাকার শিশুরা

প্রকাশিত: ১২:৩৮ অপরাহ্ণ, ডিসেম্বর ১৫, ২০২৩

জলবায়ু পরিবর্তন ঝুঁকিতে উপকূলীয় এলাকার শিশুরা

খোন্দকার মাহ্ফুজুল হক : জলবায়ু সংকট মূলত শিশু অধিকারের সংকট। শিশুদের জলবায়ু ঝুঁকি সূচক (সিসিআরএ) প্রবর্তন শীর্ষক প্রতিবেদনে ইউনিসেফ প্রথম শিশুকেন্দ্রিক জলবায়ু ঝুঁকি সূচক উল্লেখ করেছে। প্রতিটি সংকটে শিশুরাই সবচেয়ে বেশি অসহায়ত্বের শিকার হয়।

 

শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড়, নদীভাঙন, বন্যা, জলোচ্ছ্বাসসহ নানা ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ আমাদের দেশের জন্য নিয়মিত হয়ে উঠছে। ফলে বাংলাদেশের শিশুদের জন্য এসব জলবায়ু পরিবর্তনজনিত দুর্যোগ তাদের জীবন ও ভবিষ্যৎকে হুমকিতে ফেলছে। জলবায়ু পরিবর্তনের সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়ছে উপকূলে বসবাসরত শিশুদের ওপর। প্রায়ই জলোচ্ছ্বাসসহ অন্যান্য দুর্যোগে হারিয়ে যাচ্ছে কোমলমতি শিশুদের স্বর্ণালি শৈশব। জাতিসংঘের শিশু তহবিল ইউনিসেফের প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে জলবায়ু পরিবর্তনের শিকার হওয়া উচ্চ ঝুঁকিতে থাকা ৬৫ দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৫তম দেখানো হয়েছে। জার্মান ওয়াচ গ্লোবালের জলবায়ু ঝুঁকি সূচক (সিআরআই-২০১৭)তে বাংলাদেশকে শীর্ষ দশটি দেশের একটি দেশ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। বাংলাদেশ সরকার বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, খরা, জলোচ্ছ্বাস, টর্নেডো, ভূমিকম্প, নদীভাঙন, জলাবদ্ধতা, পানি বৃদ্ধি, মাটির লবণাক্ততা বৃদ্ধি, বায়ুদূষণ প্রভৃতিকে প্রধান প্রাকৃতিক দুর্যোগ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। যার প্রায় সবগুলোই উপকূলীয় জেলাগুলোয় রয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ব্যাপক প্রভাব দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের প্রায় সবগুলো জেলা বিশেষ করে, খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, ভোলা ও বরগুনা ব্যাপকভাবে পরিলক্ষিত হচ্ছে। এসব জেলাগুলোসহ অন্যান্য উপকূলীয় জেলায় বড়দের চেয়ে শিশুদের ওপর জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকির প্রভাব ব্যাপকভাবে পরিলক্ষিত হচ্ছে।

 

জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে ঘূর্ণিঝড় ও অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় শিশুরা পড়াশোনার পরিবেশ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এছাড়াও সুপেয় পানির অভাব, দারিদ্র্য, পুষ্টিহীনতা, নিরাপত্তা, স্বাস্থ্যসেবার অভাব, বাল্যবিবাহ, শিশুশ্রম, বাস্তুচ্যুত হওয়া, শিশুপাচার, অনিরাপদ অভিবাসন, যৌন নিপীড়ন, হারিয়ে যাওয়া, কিশোর গ্যাংয়ে যুক্ত হওয়া, শিশুদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাওয়া, ডায়রিয়া ও অন্যান্য প্রাণঘাতী রোগে আক্রান্ত হওয়াসহ বিভিন্ন ঝুঁকির সম্মুখীন হচ্ছে উপকূলের শিশুরা। পরিবার বিচ্ছিন্ন হয়ে অনেক শিশু আশ্রয়-প্রশ্রয় পাচ্ছে অপরাধ জগতে। লবণাক্ততা বৃদ্ধির ফলে জন্মলগ্নেই শিশু অসুস্থ, রোগাক্রান্ত ও অপুষ্টির শিকার হচ্ছে। এমনকি দুর্যোগের প্রভাবে অঙ্গহানির শিকার হয়ে শিশুরা বেড়ে উঠছে বঞ্চনার মধ্যে দিয়ে।

 

সেভ দ্য চিলডেন-এ এ প্রকাশিত এক নিবন্ধে বলা হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ডায়রিয়া, অপুষ্টি ও ম্যালেরিয়ার প্রকোপ বাড়ছে। যার সহজ শিকারে পরিণত হচ্ছে উপকূলের কোমলমতি শিশুরা। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে আর্থসামাজিক নানা সমস্যায় ভুগছে উপকূলীয় এলাকার মানুষ। বিশেষ করে পরিবর্তিত অপ্রতুল আর্থসামাজিক অবস্থা ও সমস্যার সঙ্গে মানুষ নিজেকে খাপ খাওয়াতে অসহায় হয়ে পড়ছে। যার ফলে তাদের শিশুরাও নিজেকে খাপ সে পরিবেশে খাপ খাওয়াতে পারছে না। এতে করে বিপর্যয়কর এক পরিস্থিতির শিকারে পরিণত হতে হচ্ছে ওই সব পরিবারের শিশুর। জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে সম্পর্কিত বন্যা, ঘূর্ণিঝড় ও অন্যান্য পরিবেশগত বিপর্যয় বাংলাদেশের প্রায় দুই কোটি শিশুর জীবন ও ভবিষ্যৎকে হুমকির মুখে ফেলছে। এছাড়া উপকূলীয় অঞ্চলে বসবাসকারী প্রায় অর্ধকোটি শিশু নিয়মিত মিধিলা, আইলা, সিডর, ফণী ইত্যাদির মতো শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় ও অন্যান্য পরিবেশগত বিপর্যয়ে প্রতিনিয়ত আক্রান্ত হচ্ছে। ফলে অনেকেই তাদের ঘরবাড়ি ও কমিউনিটি ছেড়ে অন্যত্র বিশেষ করে ঢাকা ও বড় শহরগুলোতে স্থানান্তর হচ্ছে। অন্যত্র নতুন স্থানে নতুন করে জীবন শুরু করার চেষ্টার ফলে শিশুরা বিপজ্জনক শ্রম ও বাল্যবিয়ের ঝুঁকির মধ্যে পতিত হচ্ছে।

 

উপকূলীয় অঞ্চলের বিষেশ করে খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, ভোলা ও বরগুনা বহু গ্রাম জোয়ারের সময় পানিতে তলিয়ে যায়। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সরাসরি এসব গ্রাম ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ফলে এসব গ্রামের হাজার হাজার শিশু তাদের স্বাভাবিক জীবনযাপন ও বিকাশ সাধন ব্যর্থ হচ্ছে। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো প্রাত্যহিক জোয়ার ভাটা এবং বড় দুর্যোগ মোকাবিলা করার মতো অর্থনৈতিক অবস্থা তৈরিতে সক্ষম হচ্ছে না। তারা কোনোমতে জীবন নির্বাহ করছে। অর্থনৈতিক কারণে এসব পরিবার শিশুদের নিয়ে বিশেষভাবে ভাবার সুযোগ পরিবারের অন্য সদস্যদের থাকে না। বিশেষভাবে শিশুকে নিয়ে ভাবার সুযোগ তাদের নেই বললেই চলে। তাদের বেঁচে থাকতে হচ্ছে দীর্ঘমেয়াদি অপুষ্টি নিয়ে। ফলে শিশুমৃত্যু সেখানকার স্বাভাবিক চিত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে।

 

উপকূলের বহু দরিদ্র পরিবার জলবায়ু পরিবর্তনের শিকার হয়ে পরিবার-পরিজন নিয়ে শহরে বা অন্যত্র পাড়ি জমাচ্ছে। ঠাঁই নিচ্ছে রেললাইনের পাশে, শহরের কোনো এক কোণে। নদীর তীরের বেড়িবাঁধে কিংবা বস্তিতে বসবাস করতে হচ্ছে তাদের মানবেতরভাবে। সে পরিস্থিতিতে ওই পরিবার শিশুকে স্বাস্থ্যকর খাবার, শিক্ষা, পরিচ্ছন্ন বস্ত্র, পর্যাপ্ত স্বাস্থ্যসেবা, স্যানিটেশন, নির্মল বায়ু এবং বিশুদ্ধ খাবার সরবরাহ করতে প্রতিনিয়ত সংকটে পড়তে হচ্ছে। এসব সংকট নিয়েই ওই সব পরিবারের শিশুর বেড়ে উঠতে হচ্ছে। যার ফলে শিশুকে সহিংসতা, অপরাধ, বাল্যবিয়ে, শিশুশ্রমসহ অন্যান্য নেতিবাচক বিষয়ের শিকার হতে হচ্ছে।

 

ইউনিসেফের এক গবেষণায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনের বিপর্যয়ের ফলে এক কোটি ৯০ লাখের বেশি শিশুর জীবন ও ভবিষ্যৎ হুমকির মুখে রয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য বাংলাদেশ সরকার ‘ক্লাইমেট রেসিলিয়েন্ট পার্টিসিপেটরি অ্যাপরেস্টেশন অ্যান্ড রিফরেস্টেশন প্রজেক্ট’ (সিআরপিএআরপি)সহ আরও অনেক ধরনের কর্মসূচি গ্রহণ করেছে।

 

বাংলাদেশের জাতীয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অ্যাক্টের আওতায় দুর্যোগ ঝুঁকি হ্রাসে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও দপ্তর একযোগে কাজ শুরু করেছে। সপ্তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনাসহ সরকারের বিভিন্ন নীতি, বিশেষ করে নারী ও শিশু নীতিমালা এবং পরিকল্পনায় জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সমস্যায় শিশুর ক্ষেত্রে করণীয় নির্ধারণ করে সে আলোকে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে।

 

বাংলাদেশ সরকার স্মার্ট বাংলাদেশ গঠনের কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। স্মার্ট বাংলাদেশ গঠনের টার্গেটে নেয়া পদক্ষেপের মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তন ঝুঁকির আওতায় শিশু সুরক্ষার বিষয়টিকে অত্যধিক গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। ডেল্টা প্ল্যানেও বিষয়টি স্থান পেয়েছে গুরুত্বের সঙ্গে। ইউনিসেফের সঙ্গে সমন্বিতভাবেও সরকার শিশু সুরক্ষায় নানা ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করছে।

 

উপকূলীয় অঞ্চলে বিদ্যমান জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সমস্যা রোধ, দুর্যোগে জীবন রক্ষা, উন্নয়ন, অংশগ্রহণ এবং শিশুর সুরক্ষা উন্নততর করা না হলে টেকসই উন্নয়ন সম্ভব নয়। দুর্যোগকালীন ও দুর্যোগ-পরবর্তী শিশুকে সুরক্ষা প্রদান, দুর্যোগসহনীয় শিশু উপযোগী অবকাঠামো নির্মাণ, নীতি ও উদ্যোগ গ্রহণের ক্ষেত্রে শিশুদের বিষয়সমূহ ও তাদের প্রয়োজন মেটানোর পদক্ষেপ অন্তর্ভুক্তকরণসহ শিশুদের জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ক্ষতি প্রতিরোধে সক্ষম কমিউনিটি তৈরির পদক্ষেপ গ্রহণ করা এখন সময়ের দাবি বলে অনেকেই মনে করেন।

 

শিশুরাই আমাদের ভবিষ্যৎ। শিশুদের জরবায়ু ঝুঁকির মধ্যে রেখে দেশের উন্নয়ন কোনোভাবেই সম্ভব নয়। স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে শিশুর সুরক্ষা প্রদান অগ্রাধিকার পাওয়া এখন সময়ের দাবি। তাই বিষটিকে গুরুত্ব দিতে হবে। তাদের জন্য নিতে হবে বিশেষ পদক্ষেপ। শিশুদের নিরাপত্ত ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করার মাধ্যমে তাদের স্মার্ট সিটিজেন হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। তাহলেই দেশ হবে ক্ষুধা দারিদ্র্যমুক্ত বৈষ্যম্যহীন স্মার্ট বাংলাদেশ।