প্রকাশিত: ৫:০৮ অপরাহ্ণ, মার্চ ১, ২০২৫
আন্তর্জাতিক ডেস্ক : ১৯৪৫ সালের ৬ ও ৯ আগস্ট। জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে পরমাণু হামলা চালায় মার্কিন সৈন্যরা। চোখের পলকেরই ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয় শহর দুটি। সেই আক্রমণ সহ্য করতে পারেনি ‘সামুরাই যোদ্ধা’রা। সঙ্গে সঙ্গে আত্মসমর্পণ করে টোকিও। শেষ হয় প্রায় ৬০০ বছর ধরে চলা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। সে সময় অনেকেই ধারণা করেছিল যে, ছোট্ট দ্বীপরাষ্ট্রটি হয়তো আর ঘুরে দাঁড়াতে পারবে না। কিন্তু সেই ধারণাকে থোরাই মিথ্যা প্রমাণিত করেছে জাপান। ‘সূর্যোদয়ের দেশ’টির ঘুরে দাাঁড়ানোকে পুনর্জন্ম বলে ব্যাখ্যা করেছেন বিশ্লেষকরা।
যুদ্ধ থামলেও আণবিক আক্রমণের ফল ছিল সুদূরপ্রসারী। এর জেরে জনসংখ্যার বিপুল অংশকে হারায় টোকিও। পাশাপাশি, দ্বীপরাষ্ট্রটির বহু পরিকাঠামো একেবারে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু তাতেও হার মানেনি জাপান। অস্ত্র ছেড়ে আর্থিক উন্নতির দিকে নজর দেয় জাপান। আর তখনই ঘটে অলৌকিক ঘটনা। আশ্চর্যজনকভাবে কয়েক বছরের মধ্যেই আর্থিকভাবে আমেরিকাকে টক্কর দেওয়ার জায়গায় পৌঁছে যায় টোকিও।
গত শতাব্দীর ৫০-এর দশক থেকে শুরু করে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত দুরন্ত গতিতে বৃদ্ধি পায় জাপানের অর্থনীতি। এরপর কিছুটা স্থবিরতা এসেছিল। বর্তমানে বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম অর্থনীতির দেশে পরিণতহয়েছে দ্বীপরাষ্ট্রটি। টোকিওর সামনে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, চীন এবং জার্মানি। বিশ্বযুদ্বের পর আর্থিক অগ্রগতির ক্ষেত্রে জাপানের সামনে চ্যালেঞ্জ কম ছিল না। ওই সময়ে খাদ্যাভাব, বেকারত্ব এবং অস্বাভাবিক মূল্যস্ফীতির চোরাবালিতে আটকে পড়ে টোকিও। পাশাপাশি চোরাকারবারিদের স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয় ওই দ্বীপরাষ্ট্র। ১৯৪৬ থেকে ১৯৪৯ সালের মধ্যে বিদেশ থেকে ঘরে ফেরেন অন্তত ৬০ লাখ জাপানি।
টোকিওর আর্থিক সমৃদ্ধিতে দ্বিতীয় এবং সবচেয়ে বড় বাধা ছিল মার্কিন নিয়ন্ত্রণ। যুদ্ধ থামতেই দ্বীপরাষ্ট্রটির দখল নেন যুক্তরাষ্ট্রের ‘কিংবদন্তি’ সেনা অফিসার জেনারেল ডগলাস ম্যাকার্থার। জাপানের আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের উপর একরকম নিষেধাজ্ঞাই আরোপ করেন তিনি। ফলে বিদেশের বাজারে জাপানি সামগ্রীর চাহিদা হু হু করে কমতে শুরু করে। অন্যদিকে বাধা পায় কাঁচামাল আমদানি। এটি টোকিওর উৎপাদন এবং সরবরাহের ক্ষমতার সূচককে অনেকাংশে নামিয়ে দিয়েছিল।
এই পরিস্থিতিতে জাপানের আর্থিক পুনর্গঠনে বিপুল বিনিয়োগ শুরু করে যুক্তরাষ্ট্র। ফলে মার্কিন ডলারের উপর ভর করে ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়ায় টোকিওর অর্থনীতি। বৃদ্ধির সূচক ঠিক রাখতে শিক্ষার উপর জোর দেয় দ্বীপরাষ্ট্রের সরকার। কঠোর পরিশ্রমী এবং আত্মমর্যাদা সম্পর্কে সচেতন কর্মশক্তিকেও সঠিক পথে চালিত করেছিলেন সেখানকার রাজনৈতিক নেতারা।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ যেমন জাপানের অর্থনীতিকে ধ্বংস করেছিল, ঠিক তেমনই আর একটি লড়াই দ্বীপরাষ্ট্রটিতে এনে দেয় সৌভাগ্য। ১৯৫০ সালের ২৩ জুন থেকে ১৯৫৩ সালের ২৭ জুলাই পর্যন্ত রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে দুই কোরিয়া। সেই যুদ্ধ থামলে দক্ষিণ কোরিয়ায় আর্থিক পুনর্গঠনের কাজ শুরু হয়। সেখানে লগ্নি করে নিজেদের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার সুবর্ণ সুযোগ পেয়ে যায় টোকিও।
১৯৫১ সালের মধ্যে মোট জাতীয় উৎপাদন (জিডিপি) এবং রিয়েল টার্মে মাথাপিছু গড় আয়কে ১৯৩৪-৩৬ সালের পর্যায়ে নিয়ে যেতে সক্ষম হয় ‘সামুরাই যোদ্ধা’দের সরকার। পরবর্তী দু’দশকে ইঞ্জিনিয়ারিং, গাড়ি ও গাড়ির যন্ত্রাংশ তৈরি এবং বৈদ্যুতিক সামগ্রী উৎপাদনে বিশ্বের মধ্যে শীর্ষস্থান দখল করে প্রশান্ত মহাসাগরের এই দ্বীপরাষ্ট্র।
তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হলো, জেনারেল ম্যাকার্থারের প্রশাসন বেশ কিছু সংস্কারমূলক কর্মসূচি গ্রহণ করেছিল। জাপানের আজকের সমৃদ্ধিতে সেগুলো দারুণভাবে কাজে এসেছিল। বিশ্বযুদ্ধের আগে দ্বীপরাষ্ট্রটিকে একচেটিয়া ব্যবসার জন্য ছিল হাতে গোনা কয়েকটি সংগঠন বা প্রতিষ্ঠান। স্থানীয় ভাষায় সেগুলোকে বলা হতো, ‘জাইবাৎসু’। কিন্তু যুদ্ধ শেষ হতেই প্রতিষ্ঠান বা সংগঠনগুলোর বিলুপ্তি ঘটে। ‘জাইবাৎসু’র হাতে থাকা ভূ-সম্পত্তি আমজনতা বিশেষ করে চাষিদের মধ্যে ভাগ করে দেওয়া হয়েছিল।
এছাড়া বিশ্বযুদ্ধোত্তর বছরগুলোতে আমদানি কমিয়েছিল জাপান। প্রয়োজনীয় কাঁচামাল এবং খনিজ ছাড়া আর কিছুই বিদেশ থেকে কিনত না সেখানকার সরকার। সেনাবাহিনীর পিছনে বিপুল খরচ এবং যুবকদের বাধ্যতামূলকভাবে বাহিনীতে যোগদান বন্ধ হওয়ায় কলকারখানার জন্য প্রশিক্ষিত সুশৃঙ্খল লোকবল পেয়েছিল টোকিও। নারীদেরও শিল্পোৎপাদনের ক্ষেত্রে ব্যাপকভাবে ব্যবহার করতে থাকে ‘সূর্যোদয়ের দেশ’।
১৯৫৬ সালে আর্থিক শ্বেতপত্র প্রকাশ করে জাপানের সরকার। সেখানে বলা হয়, ‘১৯৩৯ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে অর্থনীতি ঠিক যে জায়গায় দাঁড়িয়েছিল, বৃদ্ধির সূচককে সেখানে ফিরিয়ে আনা গিয়েছে।’ উল্লেখ্য ওই সময়ে টোকিওর অর্থনীতির আকার বর্তমান অবস্থানের শতকরা এক ভাগেরও কম ছিল। আর্থিক শ্বেতপত্র অনুযায়ী, যুদ্ধ শেষের ৯ বছরের মাথায় জাপানের মাথাপিছু গড় আয় ছিল ২৬৯ ডলার। ১৯৫৬ সালে টোকিওর রপ্তানি বাণিজ্য ২০০ কোটি ডলারে পৌঁছেছিল। ওই সময়ে ৭০ কোটি ডলারের বিদেশি মুদ্রার ভান্ডার ছিল জাপান সরকারের কাছে।
১৯৬২ থেকে ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত চলা আর্থিক মন্দা ভালোভাবেই মোকাবেলা করেছিল জাপান। উল্টো ওই সময়ে টোকিওর আর্থিক প্রবৃদ্ধি ঘটে। ৬০-এর দশকে দেশটির মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের (জি়ডিপি) বৃদ্ধির হার ছিল ১১ শতাংশ। অন্যদিকে একই সময়ে জার্মানির অর্থনীতি মাত্র ৪.৬ শতাংশ এবং যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি ৪.৩ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছিল।
বিশেষজ্ঞদের একাংশ অবশ্য মনে করেন ৫০ এবং ৬০-এর দশকে জাপানি অর্থনীতির অভূতপূর্ব সাফল্যের নেপথ্যে ছিল বেসরকারি বিনিয়োগ। এই সময়ে নতুন প্রযুক্তি নিয়ে বিশ্ব বাজারে আবির্ভূত হয় দ্বীপরাষ্ট্রের একাধিক নয়া সংস্থা। তাদের তৈরি পণ্যের গুণগত মানও ছিল অসাধারণ। ফলে খুব সহজেই ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে জনপ্রিয়তা পেয়েছিল জাপানি সামগ্রী।
৭০-এর দশকের প্রথমার্থে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশে পরিণত হয় জাপান। আর্থিক বিশ্লেষকদের একাংশ বৃদ্ধির সূচক দেখে ভেবেছিলেন, অচিরে ওয়াশিংটনকেও ছাপিয়ে যাবে টোকিও। শেষ পর্যন্ত সেটা না হলেও ইস্পাত থেকে শুরু করে গাড়ি উৎপাদনে দুনিয়ায় প্রথম স্থান দখল করে ‘সূর্যোদয়ের দেশ’। এর পাশাপাশি রিয়েল এস্টেট শিল্পেও বিপুল লগ্নি করেছিল টোকিও। এর সাহায্যে ভেঙে পড়া পরিকাঠামোকে পুনরুজ্জীবিত করেন সেখানকার রাজনৈতিক নেতারা। তাতে হয় নতুন কর্মসংস্থান। ৭০-এর দশকে একটা সময়ে দ্বীপরাষ্ট্রটির মুদ্রাস্ফীতির হার প্রায় শূন্যে নেমে গিয়েছিল।
আর্থিকভাবে সমৃদ্ধশালী হয়ে উঠতে আগ্রাসী রপ্তানি বাণিজ্য নীতি নিয়েছিলেন জাপানি রাজনীতিবিদেরা। ১৯৫৩ থেকে ১৯৬০ সালের মধ্যে টোকিওর রপ্তাানি বৃদ্ধি পেয়েছিল প্রায় ৭০ শতাংশ। এতে ঝিমিয়ে পড়া অবস্থা থেকে চাঙ্গা হয়ে ওঠে সেখানকার অর্থনীতি। ১৯৭৩ সালে জাপানের মাথাপিছু জিডিপির পরিমাণ দাঁড়ায় ব্রিটেনের ৯৫ শতাংশ। যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেত্রে এই অঙ্কটি ৬৯ শতাংশে দাঁড়িয়েছিল। ১৯৯১ সালে ফেটে যায় টোকিওর অর্থনীতির বেলুন। তার পরও দ্বীপরাষ্ট্রটির মাথাপিছু জিডিপি ছিল যথাক্রমে ব্রিটেনের ১২০ শতাংশ এবং যুক্তরাষ্ট্রের ৮৫ শতাংশের বেশি।
৯০-এর দশকে মারাত্মকভাবে পড়ে যায় টোকিওর শেয়ার বাজার। এর জেরে মুদ্রাহ্রাসের সমস্যায় পড়ে জাপান। পরবর্তী বছরগুলোকে সেখান থেকে বেরিয়ে আসে প্রশান্ত মহাসাগরের ওই দ্বীপরাষ্ট্র। বর্তমানে মূলত দু’টি সমস্যা রয়েছে সেখানে। জাপানি জনসংখ্যা দ্রুত গতিতে বার্ধক্যের দিকে যাচ্ছে। অন্যদিকে কমেছে জন্মের হার। এছাড়া জিডিপির ২৫০ শতাংশের বেশি ঋণ রয়েছে ‘সূর্যোদয়ের দেশ’টির।




অফিস : ৩৭০/৩,কলেজ রোড,আমতলা, আশকোনা,ঢাকা-১২৩০,
Call : 01911120520
Email : info.sylhet24express@gmail.com
প্রধান উপদেষ্টা : আলহাজ্ব মোহাম্মদ কাপ্তান হোসেন
পরিচালক, সিলেট উইমেন্স মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও প্রতিষ্ঠাতা, আলহাজ্ব মোহাম্মদ কাপ্তান হোসেন সমাজ কল্যাণ ট্রাস্ট।
উপদেষ্টা সম্পাদক : মো. রেজাউল ওয়াদুদ চেয়ারম্যান বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন পরিষদ (বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস এনফোর্সমেন্ট কাউন্সিল)
সম্পাদক ও প্রকাশক মো: আবু বক্কর তালুকদার
ব্যবস্থাপনা সম্পাদক : নূরুদ্দীন রাসেল
Design and developed by Web Nest