সিলেট সিটি কর্পোরেশনের হোল্ডিং ট্যাক্স নিয়ে এলাহি কাণ্ড! ক্ষুব্ধ নগরবাসী

প্রকাশিত: ৮:৩৬ অপরাহ্ণ, মে ৬, ২০২৪

সিলেট সিটি কর্পোরেশনের হোল্ডিং ট্যাক্স নিয়ে এলাহি কাণ্ড! ক্ষুব্ধ নগরবাসী

নিজস্ব প্রতিবেদক : সিলেট সিটিকর্পোরেশন নতুন এসেসমেন্টের উপর ভিত্তি করে নগরবাসীর উপর ভৌতিক হোল্ডিং ট্যাক্স বসিয়েছে।
শতকরা ৫ হাজার থেকে শুরু করে ১০ হাজার ১১ ভাগ পর্যন্ত ট্যাক্স বাড়ানো হয়েছে। পৃথিবীর কোন দেশে এমন নজির আছে বলে কারো জানা নেই। কেউ কেউ বলছেন এই কর্ম করে সিসিক গ্রিনিচ বুকে নিজেদের নাম লিখাতে পারবে। ট্যাক্স বাড়ে শতকরা ৫,১০ কিংবা ৫০ ভাগ আর এটাই স্বাভাবিক নিয়ম। সিসিক বাড়িয়েছে শতকরা ১০ হাজার ভাগ কোন কোন ক্ষেত্রে এর চেয়ে আরো বেশি।

 

রবিবার (৫ মে) সিলেট সিটিকর্পোরেশন প্রাঙ্গনে গিয়ে দেখা যায় মানুষের দীর্ঘ লাইন। নতুন এসেসমেন্টে হোল্ডিং ট্যাক্সের শতকরা হার নিয়ে নাগরিকরা ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। অনেকেই ভৌতিক এবং অমানবিক হোল্ডিং ট্যাক্সের এই কার্যক্রম বন্ধ এবং বাতিল করার দাবী জানান। প্রয়োজনে তারা মামলা এবং গণআন্দোলন করারও হুমকি দেন।

 

কারণ- সিলেট মহানগরের এই ২৭টি ওয়ার্ডে সিসিক কর্তৃপক্ষ হোল্ডিং ট্যাক্স বাড়িয়েছেন প্রায় ২০০ গুণ পর্যন্ত। এতে ক্ষোভ প্রকাশ করছেন ক্যাম্পে আসা প্রায় সবাই। বলছেন- ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’র মতো এই ভৌতিক ও অযৌক্তিক ট্যাক্স আরোপ করা হয়েছে। এমন পরিমাণের বাড়ানো বিল পরিশোধ করা অনেকের জন্যই দুঃসাধ্য বিষয় হয়ে দাঁড়াবে।

 

তবে সিসিক কর্তৃপক্ষ বলছেন- কারো কাছে ট্যাক্স বেশি মনে হলে লিখিতভাবে আপত্তি জানানোর সুযোগ রয়েছে। সেটি যাচাই করে পরবর্তীতে তাঁর ট্যাক্স পুনঃনির্ধারণ করা হবে। এছাড়া বর্তমানে আরোপিত হোল্ডিং ট্যাক্সের অ্যাসেসমেন্ট (মূল্যায়ন) এই পরিষদের সময়ে হয়নি। হয়েছে সাবেক মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী দায়িত্বে থাকাকালে।

 

সোমবার (৬ মে) বেলা ২টার দিকে নগরভবনে গিয়ে দেখা যায়, ভবনের প্রাঙ্গণজুড়ে শামিয়ানা টানিয়ে করা হয়েছে বড় একটি ক্যাম্প। ক্যাম্পটি শুরু হয়েছে ৩০ এপ্রিল থেকে, চলবে ১৪ মে পর্যন্ত। তবে সরকারি ছুটির দিন ক্যাম্পে কোনো কার্যক্রম হবে না। ক্যাম্পের মধ্যে রয়েছে ৪০টির মতো বুথ। এর মধ্যে প্রতিটি ওয়ার্ডের জন্য আলাদা বুথ, একটি ইনফরমেশনের জন্য এবং বাকিগুলো লিখিতভাবে আপত্তি জানানোর। ক্যাম্পের বিভিন্ন খুুঁটিতে লাগানো রয়েছে হোল্ডিং ট্যাক্স-বিষয়ক নানা তথ্যসম্বলিত ফেস্টুন। তথ্য জানা বা ট্যাক্স দেওয়ার ওয়ার্ড-নির্দিষ্ট কয়েকটি বুথের সামনে দেখা গেলো নারী-পুরুষের দীর্ঘ সারি। এছাড়া প্রাঙ্গণজুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছেন লোকজন। সবার মুখে একটাই কথা- হঠাৎ করে হোল্ডিং ট্যাক্স খুব বেশি বাড়িয়ে দিয়েছে সিসিক কর্তৃপক্ষ। যা তাদের জন্য পরিশোধ করা কষ্টদায়ক হবে। তবে বেশ কয়েকজনকে ট্যাক্স পরিশোধ করতেও দেখা গেছে।

 

এদিকে শুধু তথ্য জানা বা ট্যাক্স দেওয়ার ওয়ার্ড-নির্দিষ্ট বুথগুলোর সামনেই লম্বা সারি নয়, আপত্তি জানানোর কয়েকটি বুথের সামনেও দেখা গেলো মানুষের বেশ ভিড়। তারা নির্দিষ্টি ডি-ফরম পূরণ করে লিখিতভাবে তাদের আপত্তি জানাচ্ছেন।

 

আপত্তি-বুথের সামনে দাঁড়ানো মহানগরের ১৭ নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা রুবেল আহমদের সঙ্গে কথা হয় এ প্রতিবেদকের। তিনি বলেন- ‘আমার থাকার এবং দোকানকোটা- দুটোরই হোল্ডিং ট্যাক্স অতিরিক্ত হারে বাড়ানো হয়েছে। আমার থাকার ঘর এক তলা, পাকা। আগে বছরে ট্যাক্স দিতাম ৫০০ টাকা। এখন নতুন করে নির্ধারণ করা হয়েছে ৮ হাজার টাকা। দোকানকোটার জন্য আগে বছরে ট্যাক্স দিতাম ৮০০ টাকা। এখন দিতে হবে ১৮ হাজার টাকা। এই পরিমাণের টাকা দেওয়া কি সম্ভব? বর্তমানে তো খেয়ে-পরে বাঁচাই দায়, এই সময়ে যদি সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষ আমাদের ঘাড়ের উপর এমন ট্যাক্স চাপিয়ে দিয়েছে। আমি তো রীতিমতো দিশেহারা হয়ে গেছি। তাই লিখিত আপত্তি জানাবো। দেখি পরবর্তীতে কী হয়।’

 

২৪ নং ওয়ার্ডের মো. খালেদ আহমদ নামের একজন দেখালেন আগের বাৎসরিক ট্যাক্স এবং আজকে (সোমবার) ত্রৈমাসিক ট্যাক্স দেওয়ার দুটি রশিদ। দেখা গেলো- আগে তিনি তাঁর দুতলা পাকা বাসার জন্য বছরে মাত্র ৯৪৪ টাকা ট্যাক্স দিতেন। এখন ৩ মাসের ট্যাক্স পরিশোধ করেছেন ৪ হাজার টাকা। অর্থাৎ বছরে তাঁকে পরিশোধ করতে হবে ১৬ হাজার টাকা। তাঁর হোল্ডিং ট্যাক্স বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে প্রায় ১৬ গুণ।

 

খালেদ বলেন- আমি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের পুরো ট্যাক্স আজ দিতে পারিনি। কষ্ট করে ৪ হাজার টাকার ব্যবস্থা করে ৩ মাসের ট্যাক্স আদায় করেছি। সিসিক কর্তৃপক্ষ ৩ মাস করে পরিশোধ করার ব্যবস্থা রেখেছেন।

 

হোল্ডিং ট্যাক্সের বিষয় নিয়ে পরে সরাসরি কথা হয় প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা ও এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট মো. মতিউর রহমান খানের সঙ্গে। তিনি  বলেন- ‘হোল্ডিং ট্যাক্সের জন্য দুই ধরণের অ্যাসেসমেন্ট (মূল্যায়ন) করা হয়। একটি জেনারেল অ্যাসেসমেন্ট, ৫ বছর পর পর হয়। আর আরেকটি অ্যাসেসমেন্ট করা হয় প্রতি বছর, সিসিকের রাজস্ব শাখার নিজস্ব লোক দিয়ে। তবে সিসিকে ২০০৫ সালের পর কোনো অ্যাসেসমেন্ট হয়নি। ২০০৫ সালের অ্যাসেসমেন্টের নির্ধারিত হোল্ডিং ট্যাক্স ২০০৭ সাল থেকে কার্যকর হয়। তবে ২০১১ সাল থেকে গণপূর্ত অধিদপ্তর (পিডব্লিউডি) কর্তৃক সিটি করপোরেশনের জন্য নির্ধারিত হোল্ডিং ট্যাক্স নগরবাসীর কাছ থেকে আদায় করা হতো। তবে বর্তমানে আরোপিত হোল্ডিং ট্যাক্সের অ্যাসেসমেন্ট ২০১৯-২০ অর্থবছরে করা হয় এবং এখন সেটি মহানগরের পুরাতন ২৭টি ওয়ার্ডের জন্য কার্যকর করা হয়েছে। আর নতুন ওয়ার্ডগুলোতে অ্যাসেসমেন্টের কাজ চলমান রয়েছে, শেষ হলে এসব ওয়ার্ডের বাসিন্দাদের হোল্ডিং ট্যাক্সের পরিমাণ জানিয়ে দেওয়া হবে।’

 

সিসিক সূত্র জানায়, বর্তমানে নির্ধারিত হোল্ডিং ট্যাক্সের জন্য ফিল্ড সার্ভে হয় ২০১৯-২০ অর্থবছরে। ২০২১ সালের আগস্টে তৎকালীন সিসিক পরিষদের বিশেষ সভায় সেটি পাস হয়। কর ধার্য্যের অর্থবছর নির্ধারণ করা হয় ২০২১-২২ সাল। ওই অ্যাসেসমেন্টে মোট ৭৫ হাজার ৪শত ৩০ টি হোল্ডিংয়ে ১ শত তেরো কোটি ২৭ লক্ষ ৭ হাজার ৪ শত ৪৫ টাকা লক্ষ্য মাত্রা নির্ধারণ করা হয়। সেটি অনুমোদনের জন্য স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করা হলে পরে ২০২১ সালের অক্টোবরে তা অনুমোদিত হয়।

 

সিসিকের সম্প্রতি আরোপিত হোল্ডিং ট্যাক্স নির্ধারণের পদ্ধতি সম্পর্কে মো. মতিউর রহমান খান বলেন- ‘ইমারত ও জমির উপর কর ৭%, ময়লা নিষ্কাশন রেইট ৭%, সড়কবাতি রেইট ৭% ও পানি ৩%- এই মো ২০%। অন্যদিকে, স্থাপনা পাকা হলে প্রতি বর্গফুট ৫, আধা-পাকা ৩, কলোনি ৫ ও বাণিজ্যিক ৭ টাকা।’

 

ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন- ‘যদি কারো হোল্ডিং-এর ভাড়া মূল্য প্রতি মাসে ১০ হাজার টাকা হয়, তবে নিজে ব্যবহারের ক্ষেত্রে কর ভিত্তি হিসাবের জন্য তার হোল্ডিং-এর বার্ষিক মূল্য হবে ১ লক্ষ ২০ হাজার টাকা এবং হোল্ডিং ট্যাক্স-এর পরিমাণ হবে বার্ষিক ১২ হাজার টাকা। তবে সিসিক ছাড় দিয়েছে। যেমন- রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় বাবদ ২ মাসের ভাড়া মূল্যের সমপরিমাণ অর্থ (যদি) ১০ হাজার টাকা ধরা হয়েছে। এছাড়া মালিক নিজে ভবন ব্যবহার করলে, ভবনের বার্ষিক মোট মূল্য থেকে রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় বাবদ অর্থ ছাড় দেয়ার পর অবশিষ্ট ভাড়া মূল্যের উপর আরও ৪০% ছাড় দেওয়া হয়েছে। সব ছাড়ের পর (মাসিক ভাড়া ১০ হাজার হিসাব ধরে) বার্ষিক ১ লাখ ২০ হাজার টাকা নয়, অর্ধেক ভাড়া অর্থাৎ- ৬০ হাজার টাকার করের ভিত্তি হিসাবে বার্ষিক হোল্ডিং ট্যাক্স নির্ধারণ করা হয়েছে।’

 

২৭টি ওয়ার্ডের বাসিন্দাদের অভিযোগ-আপত্তি নিয়ে সিসিকের প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা মো. মতিউর রহমান খান বলেন- ‘মূলতঃ হোল্ডিং ট্যাক্স খুব বেশি বাড়ানো হয়নি। স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোতে সাধারণত প্রতি ৫ বছর পর একবার করে হোল্ডিং ট্যাক্স নির্ধারণ করার নিয়ম। কিন্তু সিসিকে দীর্ঘদিন তা করা হয়নি। প্রায় ২০ বছর পর নতুন হোল্ডিং ট্যাক্স নির্ধারণ করায় মানুষের কাছে একটু বেশি-ই মনে হচ্ছে। তারপরও সিসিক কর্তৃপক্ষ আপত্তি করার সুযোগ রেখেছে। নির্দিষ্ট ডি-ফরম পূরণ করে তার যৌক্তিক দাবি তুলে ধরলে তা যাচাই করা হবে। আর এটি যাচাই করার জন্য কয়েক দিনের মধ্যেই রিভিউ বোর্ড গঠন করা হবে। এই বোর্ড পরবর্তীতে শুনানির দিন ধার্য্য করবে এবং আপত্তিকারীর দাবি যৌক্তিক হলে তাঁর ট্যাক্স কমিয়ে দেওয়া হবে।’

 

তিনি বলেন- ‘মহানগরে উন্নয়নের জন্য মন্ত্রণালয় থেকে প্রাপ্ত বরাদ্দের পাশাপাশি সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষও ২০% অর্থ দিতে হয়। আর সিটি করপোরেশনের আয়ের বড় দিক হচ্ছে হোল্ডিং ট্যাক্স। তাই সব কিছু মিলিয়ে বর্তমানে আরোপিত হোল্ডিং ট্যাক্স আসলে খুব বেশি নয়।’

 

মো. মতিউর রহমান খান জানান- বর্তমানে প্রায় ৬০ লক্ষ টাকা হোল্ডিং ট্যাক্স বকেয়া রয়েছে। তিনি বলেন- প্রতি বছর নাগরিকদের নিয়মিত বিল পাঠিয়ে দেওয়া হয়। বিল পাওয়ামাত্র অনেকেই পরিশোধ করে যান। অনেকে বকেয়া রাখেন। বকেয়ার ক্ষেত্রে ৩ মাস পর সিসিক প্রাথমিক নোটিশ পাঠায়। পরবর্তীতে আরেকটি নোটিশ এবং এরপর তাঁর স্থাপনা ক্রোকের নোটিশ পাঠানো হয়। তারপরও ট্যাক্স আদায় না করলে স্থাপনা ক্রোক করার নিয়ম। তবে সিলেটে এ পর্যন্ত এমন ঘটনা এখনো ঘটেনি।