ফ্রান্সের প্রেসিডেন্টের ঐতিহাসিক সফর : সাদরুল আহমেদ খান

প্রকাশিত: ১২:২১ অপরাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ১০, ২০২৩

ফ্রান্সের প্রেসিডেন্টের ঐতিহাসিক সফর : সাদরুল আহমেদ খান

স্কোয়াড্রন লিডার (অব) সাদরুল আহমেদ খান : ফরাসি প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল ম্যাক্রো আজ ১০ সেপ্টেম্বর ঢাকা সফরে আসছেন। ফ্রান্সের কোন প্রেসিডেন্টের সর্বশেষ বাংলাদেশে এসেছিলেন ৩৩ বছর আগে। আমরা বাংলাদেশীরা ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ও জনগণকে শুভেচ্ছা জানাই। ফ্রান্স ও বাংলাদেশের সম্পর্ক মূলত আরএমজি বা তৈরী পোশাক রপ্তানি, প্রতিরক্ষা ক্রয়, জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশন, জলবায়ু পরিবর্তন এবং পরিবেশ রক্ষা, শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক লেনদেন, প্রযুক্তি ও বিনিয়োগ ইত্যাদি ক্ষেত্রে বিদ্যমান।

 

ফরাসি জনগণ বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশের পরম বন্ধু। জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে ফরাসি ডাক বিভাগ স্মারক ডাকটিকিট প্রকাশ করেছিল। জাতির পিতার নীতি, আদর্শ, ত্যাগ ও জীবনসংগ্রাম পৃথিবীর সব মুক্তিকামী মানুষের জন্য অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করে।

 

সমসাময়িক ভূরাজনৈতিক বিবেচনায় বিশ্বের কাছে দক্ষিণ এশিয়ায় দেশ বাংলাদেশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ মূহুর্তে একটানা ক্ষমতায় থাকা সবচেয়ে অভিজ্ঞ রাস্ট্রনায়ক। এসময়ে এমানুয়েল ম্যাক্রোর বাংলাদেশ সফর নানাভাবে আলোচনায় আসছে বার বার।

 

ফ্রান্স বিশ্ব রাজনীতির প্রভাবশালী দেশ, জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য,ইউরোপের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার অন্যতম স্তম্ব। ফ্রান্সের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যও অনেক গভীর। আমাদের দেশের আহসান মঞ্জিলও ফরাসি স্থাপত্য নিদর্শন।

 

জাতিসংঘসহ বিশ্বের শীর্ষ দুটি অর্থনৈতিক জোট জি-৭ এবং জি-২০–এর সদস্য ফ্রান্স। এবছর জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনে জোটের সদস্য না হয়েও বাংলাদেশ যোগদান করেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এ এক বিরল কুটনৈতিক সাফল্য। দিল্লীতে অনুসঠিত এই জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দিয়েই ফরাসি প্রেসিডেন্ট ঢাকা আসবেন।

 

ফ্রান্স ও বাংলাদেশের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক জোরদার করা ফরাসি রাস্ট্রপতির সফরের লক্ষ্য হতে পারে। শক্তিশালী দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের বিষয়গুলো হতে পারে:

 

১। আরএমজি বা তৈরী পোশাক রপ্তানি:

 

ফ্রান্স আমাদের পোশাক রপ্তানির অন্যতম ভালো বাজার, যেখানে বার্ষিক রপ্তানি প্রায় আড়াই বিলিয়ন ডলারের, সহজ কথায় ভারত ও চীনে আমাদের মোট রপ্তানির চেয়েও বেশি। এছাড়াও বাংলাদেশের এক্সপার্ট ডাইভার্সিফাই করতে হিমায়িত খাদ্যদ্রব্য,মসলা, হস্তশিল্প, আইটি খাত, পাটও পাটজাত অন্যান্য রপ্তানি ব্যবসা সম্প্রসারণের আলোচনা হতে পারে।

 

২। প্রতিরক্ষা ক্রয়:

 

ফ্রান্সের কাছ থেকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী থালেস এয়ার ডিফেন্স রাডার, মর্টার, ইউটিলিটি ট্রাক, ইঞ্জিনিয়ারিং স্পেশাল ভেইক্যাল, আমি এভিয়েশনের ইউরোকপ্টার ডফিন হেলিকপ্টার ক্র‍য় করেছে।

 

বাংলাদেশ ও ফ্রান্স নৌবাহিনী উভয়ই “ইন্ডিয়ান ওসেন সিম্পোজিয়ামের” সদস্য হিসেবে যৌথ মহড়া ও একে অপরের দেশে সমূদ্র যাত্রা করে থাকে।
বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর সাথে ফ্রান্স বিমান বাহিনীর বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বিদ্যমান রয়েছে। দুদেশের বিমান বাহিনীর মধ্যে বিভিন্ন প্রশিক্ষণ ও উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধি ভ্রমন চলমান আছে। ঢাকা ও কক্সবাজার বিমান বন্দরের এয়ার টাফিক সিস্টেম ফ্রান্স থেকে কেনা।

 

বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর ফাইটার ট্রেইনার ফুগা এয়ারক্রাফট ফ্রান্সের তৈরী ছিল যা এখন আর উড্ডয়ন করেনা। এবারের আলোচনায় ফ্রান্সের তৈরী “রাফায়েল” মাল্টিরোল কম্ব্যাট এয়ারক্রাফট বিক্রির প্রস্তাব আসতে পারে, ইউএভি বা ড্রোনের চাহিদা দিন দিন বাড়ছে তাই এটাও থাকছে এজেন্ডায়। তবে বাংলাদেশ বিমানের জন্য ১০টি এয়ারবাস উড়োজাহাজ কেনার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হতে পারে।

 

 

৩। জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশন:

 

জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশ সেনারা অবদান রাখছে এবং ফ্রান্স বিশ্ব শান্তিরক্ষা প্রচেষ্টায় বাংলাদেশের ভূমিকাকে স্বীকৃতি ও প্রশংসা করেছে। বাংলাদেশ ও ফ্রান্স বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় একসঙ্গে কাজ করছে। বিশেষ করে “প্যারিস এজেন্ডা ফর পিপলস অ্যান্ড দ্য প্ল্যানেটে”র কাঠামোর সক্রিয় সমর্থক ঢাকা।
ফ্রান্সও জাতিসংঘের শান্তি মিশনের বড় অংশীদার। ফরাসি প্রেসিডেন্টের সফরে শান্তি রক্ষা মিশনে সবচেয়ে বেশি সৈন্য প্রদানকারী দেশ বাংলাদেশ বাড়তি কোনো সুবিধা নিয়ে সমঝোতার সুযোগ সৃষ্টি হবে বলে মনে করা হয়।

বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গাদের আশ্রয় এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায়ও বাংলাদেশের পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি পুণর্ব্যক্ত করতে পারে ফ্রান্স সরকার।

 

৪। জলবায়ু পরিবর্তন এবং পরিবেশ রক্ষা:

 

বাংলাদেশ এবং ফ্রান্স উভয়ই জলবায়ু পরিবর্তন সমস্যা মোকাবিলায় সক্রিয়ভাবে জড়িত। ফ্রান্স নবায়নযোগ্য শক্তি এবং জলবায়ু অভিযোজন–সম্পর্কিত প্রকল্পসহ জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় বাংলাদেশের কিছু প্রচেষ্টাকে সমর্থন করেছে। সৌর ও বায়ু বিদ্যুৎ খাতে বিনিয়োগের ইচ্ছা প্রকাশ করতে পারেন ফরাসী রাস্ট্রনায়ক।

 

৫। শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক লেনদেন:

 

এমানুয়েল ম্যাক্রোর সফরে আলিয়ঁস ফ্রঁসেজের কার্যক্রম বাড়ানো, উচ্চশিক্ষা ও গবেষণার ক্ষেত্র বিস্তার করার প্রয়াস চালানো হতে পারে। এছাড়া দক্ষ জনশক্তি রাপ্তানি ও ফ্রান্সে বৈধতার অপেক্ষায় থাকা বাংলাদেশীদের জন্য সুখবর আসতে পারে এবারের আলোচনার টেবিল থেকে।

 

৬। প্রযুক্তি ও বিনিয়োগ :

 

এর আগে ফ্রান্সের থালিস বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ বানিয়েছে। থালিস ও এয়ারবাস নিখুঁত স্যাটেলাইট ইমেজ প্রসেসিং (জিআইএস) ডেটা সরবরাহ করে, সাশ্রয়ী চুক্তি করা গেলে এসব জিআইএস ডেটা বাংলাদেশের বন্যা, কৃষি ব্যবস্থাপনা ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় ব্যাপক পরিসরে কাজে লাগানো যেতে পারে। বাংলাদেশ মহাকাশ গবেষণা সংস্থা স্পারসোর আবহাওয়া ও কৃষিবিষয়ক প্রকল্পের জন্য খুব কম খরচে ব্যাপক পরিসরে জিআইএস ডেটা দরকার।

রূপপুরের পরে বাংলাদেশের দ্বিতীয় পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং উন্নত রেল প্রযুক্তির বিষয়ে ফ্রান্স আগ্রহ দেখাতে পারে।

 

এমানুয়েল ম্যাক্রোর লক্ষ্য হতে পারে ফরাসি ব্যবসা বিকাশের চেষ্টা করা। একটা কথা স্বীকার করতেই হবে, ইউক্রেন সংকট, অর্থনৈতিক মন্দা, আফ্রিকার কয়েকটি দেশে সামরিক শাসন জারি, নাহেলের মৃত্যুতে জাতিগত দাঙ্গা ইত্যাদি কারণে ক্ষতিগ্রস্ত অর্থনৈতিক পুনর্জন্ম দিতে চান এমানুয়েল মাখোঁ, হয়তো নতুন বাজার তৈরীতে নিজেই আসছেন বাংলাদেশে।

 

প্রায় তিন দশক পরে ফরাসী কোন রাস্ট্রপ্রধানের বাংলাদেশ ভ্রমণের সুযোগটাকে টেকসইভাবে কাজে লাগানোর সামর্থ্য রয়েছে বাংলাদেশে শেখ হাসিনার নেতৃত্বের বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের। ইপিজেড, ইজেড, শতভাগ বিদ্যুৎ, পদ্মা ব্রীজ, মেট্রোরেল, বঙ্গবন্ধু টানেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েসহ বদলে যাওয়া সোনার বাংলাদেশে ফ্রান্স বিনিয়োগ বৃদ্ধি করতেই পারে। একইসঙ্গে, ফ্রান্সের প্রযুক্তিগত সক্ষমতা থেকে বাংলাদেশও উপকৃত হবে। দুদেশের মধ্যে এসব ব্যাপারে আলোচনা শেষে যৌথ বিবৃতি আসতে পারে, আর এক্ষেত্রে প্রাধান্য পাবে বাংলাদেশ। কেননা আলোচনার টেবিলে যিনি বসবেন, তিনি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

 

লেখক: সদস্য, অর্থ ও পরিকল্পনা বিষয়ক উপকমিটি, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ।