থমকে গেছে পরিবার পরিকল্পনা কার্যক্রম

প্রকাশিত: ৩:৫৮ অপরাহ্ণ, আগস্ট ১৭, ২০২২

থমকে গেছে পরিবার পরিকল্পনা কার্যক্রম

অনলাইন ডেস্ক : জনবহুল দেশ হওয়া সত্ত্বেও বিগত বছরগুলোয় জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ, শিশুমৃত্যুর হার হ্রাসে দারুণ সাফল্য দেখিয়েছে বাংলাদেশ। কিন্তু করোনার মহামারি শুরু হলে জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছানো স্বাস্থ্যসেবা চলে গেছে তাদের নাগালের বাইরে।

কিন্তু করোনার প্রভাব কমে গেলেও সে পরিস্থিতি আর পরিবর্তিত হয়নি। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে অধিদপ্তরের উদাসীনতা। সবমিলে থমকে গেছে এ সংক্রান্ত মাঠপর্যায়ের সেবা।

নাটোর, কুমিল্লা, রাজশাহী, বরিশাল, যশোরসহ সারা দেশের এক ডজন জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে অনুসন্ধান চালিয়ে পাওয়া গেছে একই ধরনের তথ্য। অভিযোগ পাওয়া গেছে, স্বাস্থ্যসেবার জন্য পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের নিয়োগপ্রাপ্ত মাঠকর্মীরা এখন আর আগের মতো বাড়ি বাড়ি গিয়ে কাজ করেন না।

এ ব্যাপারে কথা হয় নাটোরের সিংড়া উপজেলার হুলহুলিয়া গ্রামের বাসিন্দা মোবারক হোসেনের সঙ্গে। তিনি জানালেন, বছর দুয়েক আগেও তার স্ত্রীর কাছে নিয়মিত আসতেন পরিবার পরিকল্পনার মাঠকর্মীরা। সেখান থেকেই পিলসহ নানা জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রী ও পরামর্শ নিত তার পরিবার। কিন্তু এখন আর কেউ আসে না। তার ধারণা, সরকারি এই সুবিধা এখন বন্ধ হয়ে গেছে।

একই ধরনের চিত্র খুঁজে পাওয়া গেছে দেশের নানা প্রান্তে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের একজন কর্মকর্তা জানান, ‘স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রমে গতি আনার জন্য সরকারের প্রচেষ্টার কোনো কমতি নেই। কিন্তু করোনাকালে ঘর থেকে বের না হওয়ার যে বিধিনিষেধ আরোপ হয়েছিল, সেই বিধিনিষেধের পর আর সেবা কার্যক্রম গতি পায়নি। ফলে গোটা দেশেই যে যার মতো বসে বসে বেতন গুনছে।’

এ বিষয়ে যথাযথ উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে না কেন জানতে চাইলে ওই কর্মকর্তা বলেন, ‘দেখুন, ৬০/৭০ হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারী এই অধিদপ্তরে কাজ করেন। সেবা খাতের এই প্রতিষ্ঠানটি পরিচালনার জন্য ডায়নামিক নেতৃত্ব দরকার। সঠিক পরিচালনা ছাড়া এমন প্রতিষ্ঠানে সাফল্য আসবে না।’

তাহলে কি বর্তমান মহাপরিচালকের সেই ক্ষমতা নেই? এই প্রশ্ন সেই কর্মকর্তা এড়িয়ে গেলেও জানা যায়, পরিবার পরিকল্পনার বর্তমান মহাপরিচালক সাহান আরা বানু দীর্ঘদিন ধরেই অসুস্থ। তিনি অফিস করলেও এত বড় প্রতিষ্ঠানের সবদিক সামলে ওঠার মতো অবস্থায় তিনি নেই।

জন্মনিয়ন্ত্রণ পরিকল্পনার হার কমেছে ১৫ শতাংশ: পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের তথ্যানুযায়ী, ২০১৮ সালে ১০ কোটি ৮৮ লাখ ২৭ হাজার ৩৭০ জন দম্পতির মধ্যে ৮ কোটি ৬০ লাখ ৩২ হাজার দম্পতিকে জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রী দেওয়া হয়েছে। ২০১৬ সালে যা ছিল ১০ কোটি ৬৫ লাখ ৯২ হাজার ৫১৭ জনের মধ্যে ৮ কোটি ২৬ লাখ ৯৩ হাজার ১৬৭টি।

সাম্প্রতিক বছরগুলোয় জন্মনিয়ন্ত্রণসামগ্রী ব্যবহারের হার কমেছে আশঙ্কাজনক হারে। পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের মাসিক লজিস্টিক প্রতিবেদন জুন ২০২২ অনুযায়ী কনডমের কজামশন (ব্যবহার) ছিল ৮১ লাখ ৮ হাজার ৫৫টি, ওরাল পিল ৫৮ লাখ ২০ হাজার ৮১৭, আইইউডি ১০ হাজার ২৬৫, ইঞ্জেকটেবলস ৭ লাখ ৭৮ হাজার ৩৮৫, ইমপ্লান্ট ২৪ হাজার ৬৪টি।

অন্যদিকে করোনার ঠিক দু’বছর আগে লজিস্টিক প্রতিবেদন জানুয়ারী ২০২০ অনুযায়ী কনডমের ব্যবহার ছিল ৯৪ লাখ ১০ হাজার ৩৯৯টি, সুখী বড়ি ৬৬ লাখ ৮১ হাজার ৩০৩, আইইউডি ১৩ হাজার ৬৩৮, ইঞ্জেকটেবলস ৯ লাখ ১৩ হাজার ২৯১ এবং ইমপ্লান্ট ৩২ হাজার ৩৫৭টি।
এই দুই মাসের ভোক্তা ব্যবহারের তুলনামূলক বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, কনডমের ব্যবহার কমেছে ১৩ লাখ ১ হাজার ৮৪৪টি, পিলের ব্যবহার কমেছে ৮ লাখ ৬০ হাজার ৪৮৬টি, আইইউডি ৩ হাজার ৩৭৩টি, ইঞ্জেকটেবলস ১ লাখ ৩৪ জার ৯০৬টি এবং ইমপ্লান্ট ৮ হাজার ২৯৩টি।

আর জানুয়ারি ২০২০-এর সঙ্গে জানুয়ারি ২০২২-এর পার্থক্যটা আরও বেশি। লজিস্টিক রিপোর্ট জানুয়ারি ২০২২ বলছে, ওই মাসে কনডমের ব্যবহার ছিল ৭৭ লাখ ৬০ হাজার ৬৩৩টি, ওরাল পিল ৫৮ লাখ ২৯ হাজার ২৮৫, আইইউডি ১০ হাজার ৩২৭, ইঞ্জেকটেবলস ৭ লাখ ৭৩ হাজার ২০৭, ইমপ্লান্ট ২৬ হাজার ৬২৮টি।

আর ২০২০ সালের জানুয়ারির তুলনায় ২০২২-এর জানুয়ারিতে কনডমের ব্যবহার কমেছে ১৬ লাখ ৪৯ হাজার ৭৬৬টি, পিল ৮ লাখ ৫২ হাজার ১৮টি, আইইউডি ৩ হাজার ৩১১, ইঞ্জেকটেবলস ১ লাখ ৪০ হাজার ৮৪ এবং ইমপ্লান্ট কমেছে ৫ হাজার ৭২৯টি।

একইভাবে গোটা বছরের পরিসংখ্যান টানলে দেখা যাবে জন্মনিয়ন্ত্রণসামগ্রীর ব্যবহার শতকরা ১৫ শতাংশের বেশি কমে এসেছে। দীর্ঘমেয়াদে দেশের জনসংখ্যার ক্ষেত্রে এটি বড় প্রভাব ফেলবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

এদিকে দেশজুড়ে পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর স্বাস্থসেবা কার্যক্রম চালালেও ঢাকা ও বিভাগীয় শহরগুলোয় সরকারের সঙ্গে কোলাবরেশনের মাধ্যমে বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান (এনজিও) স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে।

সম্প্রতি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সরকারের চুক্তির মেয়াদ পেরিয়ে গেলেও সেটি নবায়নের কোনো উদ্যোগ গৃহীত হয়নি। সব মিলিয়ে পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর এখন তার বিশাল কর্মীবাহিনী নিয়ে কেবল সরকারি সুযোগ-সুবিধাই নিচ্ছে। মাঠ পর্যায়ের সেবা তো দূরে থাকুক, জেলা-উপজেলা পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা পর্যন্ত নিজেদের দায়িত্বের ব্যাপারে অসম্ভব রকম উদাসীন।

স্বয়ং মহাপরিচালক বরাবর প্রতিষ্ঠানের একাধিক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা প্রতিষ্ঠানের কাজের গতি হারানোর অভিযোগ করলেও সেসব নিয়ে খুব একটা আগ্রহ প্রকাশ করেননি বর্তমান মহাপরিচালক সাহান আরা বানু।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক প্রতিষ্ঠানের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে কাজ করেন এমন কয়েকজনের সঙ্গে আলাপে জানা যায়, প্রতিষ্ঠানের একনিষ্ঠ কর্মীরা এই মহাপরিচালকের ওপর চরম বিরক্ত। তিনি অসৎ লুটেরা, বিষয়টি এমন নয়। তাকে সবাই এই পদের জন্য উপযুক্ত মনে করছেন না।

কারণ, তিনি মহাপরিচালক হিসাবে যোগদানের পর প্রতিষ্ঠানের সার্বিক সাফল্যের সূচক কেবল নিম্নগামীই হয়েছে। তাই অবিলম্বে সারা দেশে অধিদপ্তরের কাজে গতি আনতে সমর্থ হবেন-এমন একজনের হাতে দায়িত্ব তুলে দেওয়ার দাবি জানান নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কর্মীরা।

এ প্রসঙ্গে কথা বলতে মহাপরিচালক সাহান আরা বানুর দপ্তরে একাধিক দিন গিয়েও দেখা করা সম্ভব হয়নি। মোবাইল ফোনেও তিনি কথা বলেননি।