৩ মিনিটে ট্রেন ছাড়ার স্বপ্ন অধরা এক যুগ

প্রকাশিত: ১২:১৭ অপরাহ্ণ, ফেব্রুয়ারি ২০, ২০২৪

৩ মিনিটে ট্রেন ছাড়ার স্বপ্ন অধরা এক যুগ

অনলাইন ডেস্ক : ঢাকার কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন থেকে মাত্র ৩ মিনিট পর পর ট্রেন ছাড়বে। এমন স্বপ্ন বাস্তবায়নে ২০১২ সালে ঢাকা-টঙ্গী-জয়দেবপুর রেল রুটে তৃতীয় ও চতুর্থ ডুয়েল গেজ রেললাইন সম্প্রসারণ প্রকল্পের কাজ শুরু হয়। ৩ বছরের মধ্যে কাজ শেষ হওয়ার কথা। কিন্তু পেরিয়ে গেছে ১২ বছর। ফলে দীর্ঘ এক যুগেও তিন মিনিট পর পর ট্রেন চলার স্বপ্ন পূরণ হয়নি।

 

দু’দফায় প্রকল্পটি সংশোধনের পর বলা হচ্ছে কাজ শেষ হবে ২০২৭ সালের জুনে। অর্থাৎ ৩ বছরের প্রকল্প ১৫ বছরে শেষ হতে পারে। আবার নাও হতে পারে। সেক্ষেত্রে ১৫ বছরেও স্বপ্নের বাস্তবায়ন নিয়ে শঙ্কা রয়েছে। প্রকল্প বাস্তবায়নে সময়ক্ষেপণে ব্যয় বেড়েছে প্রায় ৪ গুণ। দীর্ঘ সময়ে ১৩৮ কিলোমিটারের মধ্যে রেলপথ বসানো হয়েছে মাত্র ২৮ কিলোমিটার।

 

অথচ গত এক যুগে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণসহ অন্তত ৪৬টি প্রকল্প সমাপ্ত হয়েছে। নতুন ট্রেন চালু হয়েছে ১৫২টি। কিন্তু অতি-গুরুত্বপূর্ণ এ প্রকল্পের কাজ শেষ হয়নি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রকল্পটি বাস্তবায়নে পদে পদে বাধা। ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে সেই বাধার অন্যতম কারণ।

 

দেশে যে পরিমাণ ট্রেন চলাচল করে-তার প্রায় ৭৭ শতাংশ রাজধানীর কমলাপুর স্টেশন ঘিরে চলে। এ স্টেশন ঘিরে আরও বেশি সংখ্যক ট্রেন পরিচালনা এবং ভ্রমণের সময় কমিয়ে আনতে এমন প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছিল। এ প্রকল্প ঘিরেই ঢাকামুখী দু’অঞ্চলের (পূর্ব ও পশ্চিমাঞ্চল) বিভিন্ন রুটে অত্যাধুনিক নতুন ট্রেন চালু ও লাইন স্থাপন করা হয়েছে।

 

প্রতিশ্রুতি ছিল, এ প্রকল্পটি সমাপ্ত হলে ঢাকার সঙ্গে উভয় অঞ্চলের ট্রেনের সংখ্যা বাড়ানো যাবে দ্বিগুণের বেশি। রেলওয়ে পরিকল্পনা দপ্তর সূত্র বলছে, নারায়ণগঞ্জ ছাড়া দেশের বাকি অংশ ঢাকা-টঙ্গী রেললাইনের মাধ্যমে ঢাকার সঙ্গে সংযুক্ত। এটি ট্রান্স এশিয়ান রেলওয়ে নেটওয়ার্কের অংশ। এই ২২ দশমিক ৩৯ কিলোমিটার লাইনে প্রতিদিন যে পরিমাণ ট্রেন চলার কথা, তার প্রায় তিনগুণ বেশি ট্রেন ঝুঁকি নিয়ে চলে। ৩য় এবং ৪র্থ লাইন প্রকল্প সমাপ্ত হলে যথাযথ লাইনে পর্যাপ্ত পরিমাণ ট্রেন চালানো সম্ভব হবে।

 

রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ বলছে, রেলওয়ে কিংবা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কোনো গাফিলতি নেই। রেলপথ ঘিরে ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ চলমান থাকায় রেল যথাসময়ে কাজ করতে পারছে না। রেললাইনের সরাসরি ওপর দিয়ে মাইলের পর মাইল এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ হচ্ছে।

 

অপরদিকে গ্যাস, বিদ্যুৎ, ওয়াসা, সুয়ারেজ লাইন রেললাইনের নিচে এবড়ো-খেবড়ো অবস্থায় আছে। এসব লাইন সরানো এবং যথানিয়মে পুনর্স্থাপনের জন্য টাকা পরিশোধ করা হলেও সাড়া মিলছে না। চলমান লাইনের পাশে নির্মাণ সামগ্রী স্তূপ করে রাখা হচ্ছে দিনের পর দিন।

 

গত দুদিন প্রকল্প এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, কাজের গতি বাড়াতে দিন-রাত কাজ চলছে। প্রকল্পের যে এলাকাগুলোতে বাধা নেই-সেই এলাকায় পুরোদমে কাজ চলছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাধা এলাকায় মাসের পর মাস কোনো কাজ করা সম্ভব হচ্ছে না। খণ্ডে খণ্ডে টঙ্গী, জয়দেবপুর, বিমানবন্দর, তেজগাঁও রেলওয়ে স্টেশন এলাকায় কাজ চলছে।

 

খিলগাঁও-মালিবাগ এলাকায় লাইন বসানোর কাজ দ্রুততার সঙ্গে চলছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ফিল্ড ইঞ্জিনিয়ার বললেন, ‘খণ্ডে খণ্ডে কাজ করে পুরো কাজে সমন্বয়ে সমস্যা হয়। কিন্তু, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের জন্য যথাসম্ভব কাজ করা সম্ভব হচ্ছে না। আমাদের লাইনের ওপর দিয়ে এক্সপ্রেসওয়ের কাজ চলছে-অথচ আমাদের বসে থাকতে হচ্ছে। জায়গা রেলের-দাপিয়ে বেড়াচ্ছে এক্সপ্রেসওয়ে। এখনও অনেক সেকশন আমরা বুঝে পাইনি।’

 

মালিবাগ-খিলগাঁও চলমান রেলপথের দু’পাশে নতুন দুটি ডুয়েলগেজসহ একাধিক লুব লাইন করা হচ্ছে। চলমান লাইনগুলো জরাজীর্ণ। উনিশ থেকে বিশ হলেই লাইনচ্যুতের ঘটনা ঘটে। সরেজমিন দেখা গেছে, বর্তমানে যে লাইন তৈরি হচ্ছে-লাইনগুলো ৬০ কেজি লোহা (১ মিটার) দেওয়া হচ্ছে। সবচেয়ে আধুনিক লোহা ও স্লিপার যুক্ত করা হচ্ছে লাইনগুলোতে।

 

লাইন বসানো সম্পূর্ণ হলে-১০০ থেকে ১৩০ কিলোমিটার গতি নিয়ে ট্রেন চালানো যাবে। বর্তমানে এই লাইন দিয়ে ৫ থেকে ৩০ কিলোমিটার গতি নিয়ে ট্রেন চলছে। বিমানবন্দর থেকে কমলাপুর পর্যন্ত নির্মাণাধীন ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের নির্মাণ সামগ্রী লাইনের আশপাশ ঘিরে রাখা হয়েছে। ফলে রেল প্রকল্প নির্মাণে ব্যবহৃত সরঞ্জাম রাখতে সমস্যা হচ্ছে।

 

প্রকল্পের মাঠ সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ইউটিলিটি শিফটিং সমস্যাও কাজের গতি কমাচ্ছে। কমলাপুর থেকে প্রায় ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট স্টেশন পর্যন্ত রেললাইনের ওপর দিয়ে প্রায় ১১ কিলোমিটার এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ কাজও চলমান। ফলে এক্সপ্রেসওয়ে কর্তৃপক্ষও নিজেদের কাজ সমাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত রেলের বিশেষ স্থানগুলো ছাড়তে পারছে না। এ পথের প্রায় ৭ কিলোমিটার রেললাইন নির্মাণের কাজ যথাযথভাবে শুরু করা সম্ভব হচ্ছে না।

 

সংশ্লিষ্টরা বলছে, এ প্রকল্পটি ২০১২ সালে প্রাথমিক কাজ শুরু হলেও চূড়ান্তভাবে কাজ শুরু হয় ২০১৮ সালের শেষ দিকে। ৩ বছরের মধ্যে প্রকল্পে কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও তা সম্ভব হয়নি। ওই সময় কোনো সম্ভাব্যতা যাচাই ও বিস্তারিত নকশা ছাড়াই প্রকল্পটি গ্রহণ করা হয়। তখন বলা হয়েছিল, প্রকল্পের কাজ ২০১৫ সালে শেষ হবে। এখন প্রকল্পের কাজ সমাপ্ত হওয়া কথা-২০২৭ সালে। অর্থাৎ ৩ বছরের প্রকল্প ১৫ বছরে শেষের সম্ভাবনা। আর ব্যয় বেড়েছে প্রায় ৪ গুণ। শুরুতে ব্যয় ধরা হয়েছিল ৮৪৮ কোটি ৬০ লাখ। বর্তমানে ৩ হাজার ৩৪২ কোটি টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে।

 

রেলওয়ে পরিকল্পনা দপ্তর সূত্রের খবর, এ প্রকল্পের অংশ হিসাবে কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনে আরও অন্তত ৯টি প্ল্যাটফর্ম বাড়ানোর কথা। স্টেশন আউটারে অর্থাৎ খিলগাঁও লেভেলক্রসিং এলাকায় লাইন সংখ্যা আরও অন্তত ১০টি বাড়বে, যা দিয়ে খুব সহজে স্টেশনে ট্রেন প্রবেশ এবং বের হবে। মাত্র ৩ মিনিটের মধ্যে স্টেশন থেকে ট্রেন ছাড়া সম্ভব হবে।

 

কারণ স্টেশন থেকে ট্রেন ছাড়ার মুহূর্তেই লেভেলক্রসিংয়ের আগেই ৩য় এবং ৪র্থ লাইনে পূর্ণাঙ্গ গতি নিয়ে ট্রেন ছুটতে পারবে। বর্তমানে কমলাপুর থেকে একটি ট্রেন ছাড়লে প্রায় ৩৫ থেকে ৪০ মিনিট অপেক্ষা করতে হয়-পরবর্তী আরেকটি ট্রেন ছাড়ার জন্য। সিগন্যাল সমস্যা হলে উল্লিখিত সময় বেড়ে ১ থেকে দেড় ঘণ্টা সময় লেগে যায়। প্রকল্পটি সমাপ্ত হলে রেলে আমূল পরিবর্তন আসবে।

 

ঢাকা-টঙ্গী সেকশনের তৃতীয় ও চতুর্থ ডুয়েলগেজ রেললাইন এবং টঙ্গী-জয়দেবপুর সেকশনে ডুয়েল গেজ ডাবল লাইন নির্মাণ প্রকল্পেন পরিচালক প্রকৌশলী নাজনীন আরা কেয়া জানান, পুরো রেলে এ প্রকল্পটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ইতোমধ্যে যে সব প্রকল্প সমাপ্ত হয়েছে-বিশেষ করে ঢাকামুখী লাইন, সেগুলোর যথাযথ সুফল পেতে এ প্রকল্পের বিকল্প নেই। প্রকল্পটির চূড়ান্ত কাজ মূলত ২০১৯ সালে শুরু হয়।

 

এ প্রকল্পে কাজের পরিধি বাড়ানো হয়েছে। নতুন করে টঙ্গী থেকে জয়দেবপুর পর্যন্ত আরও একটি ডুয়েলগেজ ডাবল লাইন তৈরি করা হয়েছে। লুপ লাইনও বাড়ানো হচ্ছে। সর্বশেষ প্রকল্পটি মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে ২০২৭ সালের জুন মাস পর্যন্ত। ব্যয় ধরা হয়েছে ৩ হাজার ৩৪২.৫৫ কোটি টাকা। ভারতীয় লাইন অব ক্রেডিট (এলওসি-১ এবং এলওসি-৩) প্রকল্প সাহায্য ২ হাজার ৮২১.১৬ কোটি টাকা)।

 

প্রকৌশলী নাজনীন আরা কেয়া আরও বলেন, এ প্রকল্প বাস্তবায়নে পদে পদেই বাধা। প্রকল্প বিলম্ব হওয়া প্রধান কারণ- ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণসহ ইউটিলিটি শিফটিং অন্যতম। এখনও আমরা কাজের অনেক সাইড বুঝিয়ে পাইনি। ফলে পুরোদমে কাজ চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। বাধাহীন জায়গায় আমরা দিন-রাত কাজ চালিয়ে যাচ্ছি। মোট প্রকল্পে ৩৬ শতাংশ কাজ শেষ। প্রায় ১৩৮ কিলোমিটার রেলপথের মধ্যে ২৮ কিলোমিটার রেলপথ স্থাপন করা হয়েছে। বনানী থেকে মগবাজার পর্যন্ত এক্সপ্রেসওয়ের কাজ শেষ হয়নি, ওই এলাকায় আমরা যথাযথ কাজ করতে পারছি না।

কম খরচে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিন

কম খরচে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিন